পচা ফুল মালা ভাসছে। ভাসছে গলে যাওয়া প্রতিমার কাঠামো। ইতি-উতি ভেসে রয়েছে কালো-সাদা পলিপ্যাক। মাছ চাষের কারণে জলে ফেলা হচ্ছে গোবর সার। বুদবুদ কেটে মিলিয়ে যাচ্ছে সাবানের ফেনা। ঘাটের গায়ে জমাট বেঁধে রয়েছে শ্যাওলা।
প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও পুকুর নয়। দেওঘরের বৈদ্যনাথ ধাম থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে থাকা ‘শিবগঙ্গা’ কুণ্ডের এমনই দুরবস্থা। বাবা ধামে এসে যে কুণ্ডের জল পান করলে অসুখ-বিসুখ সেরে যাবে বলে এখানকার মানুষ এক সময় বিশ্বাস করত। এখন সেই বিশ্বাসটাই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে আতঙ্কে পর্যবসিত হয়েছে। এক সময় এই কুণ্ডের জল রান্নার কাজে ব্যবহার করতেন অনেকে। এখন চর্মরোগের আশঙ্কায় স্থানীয় মানুষ শিবগঙ্গার জলে হাত-পা ধুতেও ভয় পান।
ঝাড়খণ্ডের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিজ্ঞানীদের ব্যখ্যা, বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে দেওঘরের দারহাবা নদী শুকিয়ে গিয়েছে। যার জেরে শিবগঙ্গা কুণ্ডে আর নতুন করে জল আসছে না। পুরনো জলই জমে রয়েছে শিবগঙ্গাতে। সেই জল শোধন করার কিংবা নতুন কোনও উৎস থেকে জল এনে শিবগঙ্গা কুণ্ড ভর্তি করার কোনও উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে না সরকারের পক্ষ থেকে। বিকল্প উপায় বলতে, পাইপ লাইনের মাধ্যমে অজয় নদী থেকে জল এনে শিবগঙ্গা ভর্তি করার প্রস্তাব রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বোর্ডের চেয়ারম্যান মণিশঙ্কর। |
দেওঘরের শিবগঙ্গা কুণ্ড। আবর্জনায় ভরা জল। ছবি: চন্দন পাল |
চালু কথন বলছে, এই কুণ্ড তৈরি হয়েছিল রাবণের মুষ্ঠাঘাতে। দেবতাদের যুদ্ধে হারিয়ে বন্দি করার পরে রাবণ যখন দেবাদিদেব মহাদেবকে কৈলাস থেকে লঙ্কায় তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন জলের দেবতা বরুণ রাবণের পেটে ঢুকে পড়েন। রাবণ দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাব ত্যাগ করার পরে হাত ধোয়ার জলের সন্ধানে মাটিতে কিল মারেন। তৈরি হয় শিবগঙ্গা কুণ্ড।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার মানুষ পুজো দিতে বৈদ্যনাথ ধামে আসেন। তাঁদের অনেকেই নিজেদের অজ্ঞতায় শিবগঙ্গা কুণ্ডে স্নান করে মন্দিরে পুজো দিতে যান। তাঁদের আটকানোর কোনও উপায় নেই। আর কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রাবণী মেলা। তখন পুণ্যার্থীর সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। তখন শিবগঙ্গার দূষণ আরও বাড়বে বলেই দাবি বাবা ধামের পাণ্ডাদের। তাঁরাও ইতিমধ্যে ‘শিবগঙ্গা বাঁচাও’ কমিটি তৈরি করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। পাণ্ডাদের সংগঠনের সভাপতি, বিনোদ দাদ্দোয়ারির কথায়, “অবিলম্বে শিবগঙ্গায় স্নান বন্ধ হওয়া উচিত। স্নান করতে এসে অনেকে জামাকাপড় কাচছেন। তার থেকে সাবানের ফেনা জলে যাচ্ছে। জল পাল্টানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। এর ফলে যেমন জলের দূষণ বাড়ছে, তেমনই যাঁরা স্নান করছেন তাঁদেরও চর্মরোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিমার রং থেকে রাসায়নিক ছড়িয়ে জল দূষিত হচ্ছে। লোকেরা প্লাস্টিক ফেলছেন। শিবগঙ্গাকে আমরা অত্যন্ত পবিত্র কুণ্ড বলে মনে করি। কিন্তু প্রশাসন উদাসীন। কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
যদিও দেওঘরের ডেপুটি কমিশনার রাহুল পারোয়ার অবশ্য সরকারি উদাসীনতার অভিযোগ মানতে রাজি নন। তিনি জানিয়েছেন, “ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। শিবগঙ্গা কুণ্ডের জল পরিশোধনের জন্য তারা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব দিয়েছে। এর জন্য দশ কোটি টাকার প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় সরকার পঞ্চাশ শতাংশ খরচ দেবে। পঞ্চাশ শতাংশ খরচ বহন করার জন্য রাজ্যের কাছে কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাব দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে শ্রাবণী মেলার পরেই জল পরিশোধনের কাজ শুরু হবে।” |