রাজ্যে শিল্পায়ন নাই, জমি অধিগ্রহণে নিবৃত্ত সরকার রাজ্যকে কর্মসংস্থানের মরুভূমি করিয়া তুলিয়াছে। এই অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষকের মতো ন্যূনতম মানের সরকারি চাকুরির জন্যও যে পদ-পিছু শতাধিক প্রার্থী ঝাঁপাইবেন, তাহাতে আর আশ্চর্য কী? উপরন্তু দীর্ঘ কাল প্রাথমিক শিক্ষকের হাজার-হাজার পদ শূন্য থাকাতেও প্রার্থী-সংখ্যা অস্বাভাবিক বাড়িয়াছে। অতএব প্রাথমিক শিক্ষকের ৩৫ হাজার শূন্য পদের জন্য সাড়ে ৬ হাজার পরীক্ষাকেন্দ্রে ৪৫ লক্ষ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষাগ্রহণের রাজসূয় যজ্ঞ। এমন একটি বৃহৎ কাণ্ড পশ্চিমবঙ্গে যতটা অব্যবস্থার মধ্যে সম্পন্ন হওয়া সম্ভব, রবিবার তাহাই হইয়াছে। পরীক্ষাকেন্দ্রের ঠিকানা ভুল, সেখানে পৌঁছাইতে পরিবহণের অপ্রতুলতা, যান-বিভ্রাট, ঠেলাঠেলি করিয়া ট্রেনের কামরায় কিংবা বাস-ট্রাক-টেম্পোর মাথায় গাদাগাদি যাত্রা, গন্তব্যে পৌঁছাইবার হুড়াহুড়িতে দুর্ঘটনা, বিলম্ব, বিশৃঙ্খলা ও তাহা সামলাইতে পুলিশের লাঠিচার্জ, সব মিলাইয়া প্রাথমিক শিক্ষকের চাকুরিপ্রার্থী তরুণতরুণীদের চরম হেনস্থা ও দুর্ভোগের সাক্ষী থাকিল এই দিনটি। অব্যবস্থা এবং এত বৃহৎ একটি কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈয়ারির অসম্পূর্ণতা দেখাইয়া দেয়, পশ্চিমবঙ্গ এমন একটি বড় ব্যাপারের জন্য আদৌ প্রস্তুত নয়। এই প্রস্তুতিহীনতার দায় একান্ত ভাবে রাজ্যের সরকারেরই, বিশেষ করিয়া রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রক ও তাহার ছোট-বড় আধিকারিকদের। যাহারা ‘হেলে ধরিতে শিখে নাই’, তাহারা ‘কেউটে ধরিতে গেলে’ সম্ভবত এমন বিপর্যয়ই ঘটিয়া থাকে।
প্রশ্ন হইল, এই ভাবে এক দিনে এবং কেন্দ্রীয় ভাবে ৪৫ লক্ষ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষাগ্রহণের দরকার কী? স্কুলে শিক্ষকতার জন্য এমন কেন্দ্রীয় নিয়োগ-পরীক্ষার বন্দোবস্তের কোনও সুযুক্তি নাই। প্রশ্ন হইল, শিক্ষক পদে নিয়োগের পরীক্ষা এমন কেন্দ্রীয় ভাবে গ্রহণ করা কেন? কেন প্রতিটি স্কুল তাহার প্রয়োজন অনুসারে স্থানীয় ভাবে নিজেরা শূন্য পদগুলির জন্য প্রার্থী বাছাই করিবে না? অভিন্ন যোগ্যতামান নিশ্চিত করিতে বড় জোর কেন্দ্রীয় ভাবে একটি প্রশ্নপত্র তৈরির বন্দোবস্ত থাকিতে পারে। কিন্তু গোটা পরীক্ষা গ্রহণ পর্বটি রাজ্য জুড়িয়া এ ভাবে আয়োজন করার অর্থ কী? চাকুরির পরীক্ষাকেও কুম্ভ মেলার অনুরূপ একটি গণ-উৎসবের চেহারা না দিলে কি চলিতেছে না?
কেহ সংশয় প্রকাশ করিতে পারেন, স্থানীয় ভাবে প্রতিটি স্কুলের কর্তৃপক্ষকে যদি প্রাথমিক শিক্ষক পদে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্যক্তিদের নিয়োগ করিতে দেওয়া হয়, তবে সেখানে স্বজনপোষণ বা দুর্নীতির সুযোগ থাকিবে। হয়তো থাকিবে। স্থানীয় স্তরে গোটা বিষয়টির নিষ্পত্তি করিতে গিয়া অযোগ্য অথচ পছন্দের ব্যক্তিদের সরকারি চাকুরি পাওয়াইয়া দিবার প্রবণতা মাথা-চাড়া দিতেই পারে। কিন্তু দুর্নীতি কি কেবল বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থাতেই সীমাবদ্ধ থাকে, কেন্দ্রীয় স্তরে গৃহীত পরীক্ষা ও নিয়োগের বেলায় থাকে না? বরং কেন্দ্রীয় নজরদারির সুবাদে শাসক দলের নিয়োগপ্রক্রিয়াকে নিজ স্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করার সুযোগ বেশিই থাকে। সুতরাং দুর্নীতির প্রশ্ন তুলিয়া লাভ নাই, দুর্নীতি দূর করিবার অন্যান্য পন্থা রহিয়াছে, তাহা গ্রহণ করা না করা প্রশাসনিক ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। দুর্নীতি দূরীকরণের প্রধান উপায় হিসাবে কেন্দ্রীকরণকেই বাছিয়া লইবার কারণ নাই। কেন্দ্রীকরণ আসলে ক্ষমতা প্রসারেরই পন্থা, অন্যান্য যুক্তি গৌণ। শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব যদি শিক্ষাকেন্দ্রের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হয়, এবং শিক্ষাকেন্দ্রগুলি দুর্নীতি-লক্ষ্যে অযোগ্যদের নিয়োগ করে, তাহা হইলে শিক্ষাকেন্দ্রের মানই ক্ষতিগ্রস্ত হইবে, অন্যান্যদের তুলনায় পিছাইয়া পড়িবে, এবং বৃহত্তর সামাজিক চাপে ক্রমে নিজেদের ত্রুটি বিষয়ে অবহিত হইবে। এই পথ দীর্ঘ হইতে পারে, তবু এই পথই একমাত্র পথ। মান-সংরক্ষণের জন্য বরং স্কুল পর্যবেক্ষক নিয়োগ কিংবা অন্য উপায় নির্ধারিত হউক। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ নীতি হিসাবেও শ্রেয়। কিন্তু নীতির প্রশ্নে না গিয়াও বলা চলে, এই বিপুল বেকার জনসংখ্যার দেশে বর্তমান উপায়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রচেষ্টা অসম্ভব, অবাস্তব। রবিবারের অভিজ্ঞতায় তাহা বিলক্ষণ স্পষ্ট হইয়াছে। |