যানজটে অধৈর্য পরীক্ষার্থীরা ভাঙচুর চালাল বহরমপুরের গির্জার মোড়ে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ গিয়ে লাঠি উঁচিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। তবে মুর্শিদাবাদে বহু টেট পরীক্ষার্থী যানজটের কারণেই নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে পারেননি। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, এদিন সকাল থেকেই রাস্তায় কোনও ট্র্যাফিক পুলিশের দেখা মেলেনি। ফলে সকাল থেকেই জাতীয় সড়ক জুড়ে ছিল ব্যাপক যানজট। তবে নদিয়ায় মোটামুটি নির্বিঘ্নে শেষ হয় ওই পরীক্ষা।
রবিবার সকাল থেকেই বহরমপুরের উত্তরের পঞ্চাননতলা থেকে দক্ষিণের উত্তরপাড়া মোড় ছাড়িয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক জুড়ে ছিল প্রবল যানজট। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড চত্বর জুড়ে সকাল থেকে ছিল পরীক্ষার্থীদের ভিড়। |
জেলার বিভিন্ন রুটের বাসে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। এমনকী বাসের ছাদেও পরীক্ষার্থীদের ভিড়। অনেকেই লরি থেকে অটো-ছোট গাড়ি-ট্রেকারে চড়ে যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। যানজটের ফাঁসে তত ক্ষণে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে আটকে পড়ে বহু গাড়ি। যানজটের মধ্যেই কোনও ভাবে আগে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ট্র্যাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে ছোট গাড়িগুলি যেমন খুশি ঢুকে পড়ে সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই অবস্থায় ভ্যাপসা-গুমোট গরমে দীর্ঘ ক্ষণ বাস-লরি-ভাড়া করা গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে বাধ্য হন পরীক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রহরার দায়িত্বে থাকা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও যানজটে আটকে পড়েন। এক সময়ে তাঁদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। গাড়ি থেকে নেমে পরীক্ষার্থীরা গির্জার মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন। ঘড়িতে তখন দুপুর সোয়া ১২টা।
ওই অবরোধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান বহরমপুরের বিধায়ক কংগ্রেসের মনোজ চক্রবর্তী। তাঁকে সামনে পেয়ে পরীক্ষার্থীরা তাঁদের যাবতীয় অভাব-অভিযোগ উগরে দেন। পরে গির্জার মোড়ে জাতীয় সড়কের উপরে রাখা ‘রোড ডিভাইডার’ ও ‘লোহার ব্যারিকেড’ রাস্তায় ফেলে ভাঙচুর চালান তাঁরা। বহরমপুর থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাঠি উঁচিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। |
|
|
|
গির্জার মোড়ে লাঠি উঁচিয়ে
পরিস্থিতি সামাল দিল পুলিশ। |
কৃষ্ণনাথ কলেজে
নির্বিঘ্নে পরীক্ষা |
এ ভাবেই
পরীক্ষাকেন্দ্রে। |
|
বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, “অবরোধের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। কিন্তু গির্জার মোড়ে যানজটে আটকে থাকা পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি দেখে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে ফোন করি, যাতে অবিলম্বে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।” তাঁর অভিযোগ, “মুর্শিদাবাদ জেলায় যেখানে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সোয়া ১ লক্ষ, সেখানে পুলিশ ও প্রশাসনের উচিত ছিল সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা। কিন্তু প্রশাসন কোনও সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলেই পরীক্ষার্থীদের নাজেহাল হতে হয়েছে। এর দায় রাজ্য সরকারকেই নিতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে সব ক্ষেত্রেই ব্যথর্, প্রাথমিক শিক্ষ নিয়োগের পরীক্ষাতেও তা আরও এক বার প্রমাণ হল।”
অভিযোগ, বহরমপুর শহরের বিভিন্ন রাস্তায় প্রতি দিন যাঁরা যান নিয়ন্ত্রণে থাকেন, সেই ১০০ জন অস্থায়ী ট্র্যাফিক কর্মীকে বহরমপুরের বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়ায় যানজট মাত্রা ছাড়ায়। মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর অবশ্য বলেন, “৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় এদিন সকাল থেকেই পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু ট্র্যাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন যান চলাচলের ফলেই এদিন ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়।”
এদিন পরিবহণ ক্ষেত্রে যে ব্যর্থতা, তার দায় জেলাশাসক এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যানের উপরে চাপিয়েছেন তৃণমূলের জেলা শিক্ষা সেলের সভাপতি দিলীপ সিংহ রায়। তিনি বলেন, “পরিবহণ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ছিল। এর জন্য দায়ী মুর্শিদাবাদ জেলাশাসক এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান। তাঁদের জন্যই পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়েছে।” |
বহরমপুরে গির্জার মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীদের ভাঙচুর। ছবি: গৌতম প্রামাণিক। |
তৃণমূলের জেলা সভাপতি মহম্মদ আলি বলেন, “যানজটের কারণে অনেক পরীক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি। যান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন, সেই ট্র্যাফিক পুলিশের একাংশের ব্যর্থতায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটা কাম্য ছিল না।”
জেলাশাসক রাজীব কুমার বলেন, “পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্রাতিরিক্ত। তাঁদের অনেকে যেমন বহরমপুরে পরীক্ষা দিতে আসেন, আবার অনেকে বহরমপুর থেকে জেলার অন্য প্রান্তে পরীক্ষা দিতে যান। এর ফলে জাতীয় সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। ট্র্যাফিক পুলিশ নামিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।”
মুর্শিদাবাদে ‘টেট’ পরীক্ষার জন্য ১ লক্ষ ২৪ হাজার ৮৭৬ জন আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কত জন পরীক্ষা দিতে পারলেন, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে! কেননা, যানজটের পাশাপাশি পরীক্ষা কেন্দ্রের ঠিকানা বিভ্রাটের কবলে পড়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি, এমন পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। যেমন ইন্টারনেট দেখে নবগ্রাম থানার বাগমারা হাইস্কুলে পরীক্ষা দিতে যান ৩৩৯ জন পরীক্ষার্থী। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তাঁরা জানতে পারেনওই স্কুলে কোনও পরীক্ষা কেন্দ্র হয়নি। বাগমারা হাইস্কুলটি রয়েছে জলঙ্গি থানা এলাকায়, যা নবগ্রাম থেকে প্রায় ১০০ কিমি দূরে। একই ভাবে ভরতপুর থানার কাছে বনোয়ারিবাদ হাইস্কুল বলে অ্যাডমিট কার্ডে উল্লেখ থাকায় পরীক্ষার্থীরা ভরতপুর থানার কাছে বাস থেকে নেমে পড়েন। পরে জানতে পারেন ওই স্কুলটি ১৬ কিমি দূরে সালার থানার এলাকার অধীনে।
অভিযোগ, প্রথম অর্ধের পরীক্ষা দুপুর দুটোয় শেষ হওয়ার পরে জেলার বিভিন্ন স্কুলে জেলাপ্রশাসনের ওই নির্দেশ পৌঁছায়। সেই মতো মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন স্কুলে নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়। নবগ্রাম ব্লকের সিঙ্গার হাইস্কুলে যেমন দেরি করে পৌঁছানো ৫৭ জন পরীক্ষার্থীকে নিয়ে দুপুর ৩টে ২০ মিনিটে পরীক্ষা শুরু হয়। চলে ৪টে ২০ মিনিট পর্যন্ত। মূলত ‘যানজট’-এর কারণে তাঁরা সঠিক সময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি। এ ব্যাপারে ‘তদন্তে’র দাবি তুলেছেন জেলা তৃণমূল শিক্ষা সেলের সভাপতি দিলীপ সিংহ রায়। তিনি বলেন, “সরকারের গোটা বিষয়টি তদন্ত করে দেখা উচিত।” |