স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডে থিকথিকে ভিড়। বাস, ট্রেকার থেকে উপচে পড়া তরুণ-তরুণী। রিকশা, ভ্যান, গাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি। রবিবার দিনভর রাস্তায় বেরোলে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে জেলার যে কোনও প্রান্তে। তবে দু’একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া পরীক্ষা নির্বিঘ্নেই হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
রবিবার জেলার মোট ৪৪৭টি কেন্দ্রে মোট ১ লক্ষ ৯২ হাজার ৫২২ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছেন বলে জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা জানিয়েছেন। এ দিন সকাল থেকেই বর্ধমান যানজটে অচল হয়ে পড়ে। বিশেষত, বর্ধমান-কাটোয়া রোডে, পুরনো জি টি রোডে গাড়ি প্রায় এগোচ্ছিলই না। পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা জানান, পুলিশ সকাল পৌনে ৬টা থেকে এই যানজট মুক্ত করতে নামলেও ঘণ্টা দু’য়েকের আগে তা সম্ভব হয়নি। বর্ধমান স্টেশন ও তিনকোনিয়া বাসস্ট্যান্ড এ দিন জনসমুদ্রের চেহারা নেয়। |
কাটোয়া মহকুমার ৪২টি পরীক্ষাকেন্দ্রের বেশির ভাগকেই অন্য জায়গা থেকে চেয়ার-বেঞ্চ জোগাড় করতে হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অনেক পরীক্ষার্থী দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ কাটোয়া শহরে এসে পৌঁছন। তাঁদের পক্ষে ওকড়সা, ইসলামপুর, মাখালতোড় বা ভাগীরথী পেরিয়ে অগ্রদ্বীপ পৌঁছনো সম্ভব ছিল না। এ রকম বেশ কিছু পরীক্ষার্থীকে কাটোয়ার কাশীরামদাস বিদ্যায়তনে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেয় প্রশাসন। অগ্রদ্বীপ সুবোধ চৌধুরী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেন, “আমাদের স্কুলে আসানসোল-দুর্গাপুরের পরীক্ষার্থীরা ছিলেন। তাঁদের প্রথমে কাটোয়া শহর, তার পরে ট্রেনে অগ্রদ্বীপ স্টেশন পৌঁছতে হয়। সেখান থেকে ভ্যানে চড়ে অগ্রদ্বীপ ঘাটে পৌঁছে খেয়া পেরিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে আসতে হয়। এ ভাবে কী সবার পক্ষে সময়ের মধ্যে কেন্দ্রে পৌঁছনো সম্ভব?” কাটোয়া পুরসভার কর্মী তারক ঘোষ বলছিলেন, “মোটরবাইকে করে চিত্তরঞ্জন থেকে আসা দুই পরীক্ষার্থীকে অগ্রদ্বীপ ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। তা না হলে ওরা পরীক্ষায় বসতে পারতেন না।” অনেক পরীক্ষার্থী অভিযোগ করেন, দূরে কেন্দ্র দেওয়ার জন্যই তাঁদের হয়রান হতে হয়েছে। |
বৈদ্যপুরে এক স্কুলের সামনে ভিড় পরীক্ষার্থীদের। |
মঙ্গলকোটের কাশেমনগরে মহিলা স্কুলে ম্যারাপ বেঁধে একশো জনের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও অনেক জায়গায় একই বেঞ্চে দু’জনের পরিবর্তে তিন জন করে পরীক্ষার্থীকে বসানো হয় বলে অভিযোগ। পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কাটোয়া মহকুমার এক আধিকারিক মেনে নেন, “দু’তিনটি স্কুলে এমন ঘটেছে।”
দুর্গাপুর মহকুমায় ২৭,২০০ জন পরীক্ষা দিলেন ৬০টি কেন্দ্রে। দুর্গাপুর শহরে জাতীয় সড়কের ধারে একাধিক স্কুলে কেন্দ্র না দেওয়া হলেও মহকুমার প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলে তা দেওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেক পরীক্ষার্থী। রবিবার সকাল থেকে দুর্গাপুর স্টেশন ও সিটিসেন্টার বাসস্ট্যান্ডও ছিল জমজমাট। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে টিকিট কেটেও অনেকে ভিড়ের চোটে ট্রেনে উঠতে পারেননি বলে অভিযোগ। মহকুমা প্রশাসন জানায়, শুক্রবার বেসরকারি মিনিবাস ও বড়বাস মালিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে অন্য দিনের মতো এ দিন সব বাস চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। দক্ষিণবঙ্গ পরিবহণ সংস্থার ৭টি বাসও চলেছে। তৃণমূল শিক্ষা সেলের পক্ষ থেকে সিটি সেন্টার বাসস্ট্যান্ডে সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। |
কাটোয়ার এক স্কুলে দেরি হওয়ায় দৌড় পরীক্ষাকেন্দ্রের দিকে। |
লাউড স্পিকারে পরীক্ষাকেন্দ্রের অবস্থান, পরীক্ষার্থীদের কোন বাসে চড়তে হবে, অটো যাবে কি না, গাড়ি চাইলে কোথায় পাওয়া যাবে, সে সব তথ্য ঘোষণা শুরু হয় সকাল ৯টা থেকেই। কিন্তু বাস, অটো, গাড়ি যা ছিল তা পরীক্ষার্থীর সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। ফলে চড়া রোদে বাসের ছাদে মাথায় রুমাল দিয়ে অনেককে যেতে দেখা গিয়েছে।অ্যাডমিট কার্ডে পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ ছিল দুর্গাপুরের আরই কলেজ মডেল স্কুল। অথচ এক পরীক্ষার্থী সেখানে পৌঁছে জানতে পারেন, তাঁর কেন্দ্র আসলে কাঁকসার গোপালপুর হাইস্কুল। তিনি সময়ে গোপালপুর পৌঁছাতে পারেননি। আবার অ্যাডমিট কার্ডে ফরিদপুর থানা ঠিকানা থাকায় কেউ কেউ সিটিসেন্টারের অদূরে ফরিদপুর ফাঁড়ির কাছে পৌঁছে যান। অথচ ফরিদপুর থানা লাউদোহায়, যা দুর্গাপুর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। |
স্টেশনে বাইক রাখার জায়গা নেই। |
পলাশডিহা উচ্চ বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে আসা মঙ্গলকোটের সাঁকোনা গ্রামের মহম্মদ সাইদুর রহমান জানান, দশ জন মিলে একটি গাড়ি ভাড়া করে এসেছেন। যাতায়াতে রাস্তা প্রায় ২২০ কিমি রাস্তা। কিলোমিটার পিছু ১০ টাকা হারে ভাড়া দিতে হবে। তিনি বলেন, “চাকরির পরীক্ষা দিতে এত খরচ, ভাবাই যায় না!” মঙ্গলকোটের ইছাবট গ্রামের বর্ণালী নন্দী জানান, সকাল ৭টা নাগাদ গাড়ি ভাড়া নিয়ে ৬ জন বেরিয়েছেন। মাথা পিছু ২০০ টাকা ভাড়া গুণতে হবে। এ দিন তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মীকে রাস্তায় নেমে পরীক্ষার্থীদের সাহায্য করতে দেখা গিয়েছে। কিছু জায়গায় এই কাজ করতে দেখা গিয়েছে ডিওয়াইএফ কর্মীদেরও। জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনার দাবি, দু’এক জায়গায় যাত্রীবাহী বাসের যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে যাওয়ায় সাময়িক সমস্যা হয়। কিন্তু যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সমস্যা মিটিয়ে পরীক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
|
ছবি তুলেছেন, উদিত সিংহ, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেদারনাথ ভট্টাচার্য। |