স্কুলে স্কুলে পৌঁছে যাচ্ছে দেবাশিসের কষ্টের দলিল
ছেলেটা লিখছে।
মাথা ঝুলে পড়ছে টেবিলে রাখা ডায়েরির উপর। শরীরের বাঁ দিকটা হেলে পড়ছে বার বার। অনবরত কাঁপছে কলম-ধরা ডান হাত। এলোমেলো দাগ পড়ে যাচ্ছে পাতায়। সেটা থামাতে ছেলেটার মা শক্ত করে ধরলেন কলমের ডগাটা।
এ বার শব্দ তৈরি হচ্ছে পাতায়, বাক্যও
‘এখানে যদি আমার কাছে আসো
দেখতে পাবে আমি কত একা
বসে থাকি আনমনে একা....।’

এক ঘণ্টা-দু’ঘণ্টা, বয়ে যাচ্ছে সময়। মায়ের সাহায্যে কলম চলছে ছেলেটার। মোটামুটি এক বছর ধরে চলা এই অবাক লেখনীতে তৈরি হয়েছে ৬৪ পাতার বই। ছোট-ছোট গল্প-প্রবন্ধ, নাতিদীর্ঘ কিছু কবিতা আর নিজের প্রতিবন্ধী জীবনে চেপে থাকা নানা কষ্টের দলিল। মুখবন্ধে ছেলেটা বলছে
‘আজ আমি লিখব তাদের কথা
যারা পারেনি বলতে তাদের প্রতিবন্ধকতা...
কেউ তোমরা যেও না ফেলে তাদের
তারা যে সব নীরবে সয় তাদের যত কিছু যন্ত্রণা
সময় মতো পাশে থেকো, দেখবে কেমন চলে যাবে দুঃখের দিনগুলো...’

সল্টলেকের বিএল ব্লকের বাসিন্দা ৮০% শারীরিক প্রতিবন্ধী দেবাশিস দাসের মস্তিষ্কের বদ্ধতাও প্রায় ৭০ শতাংশ। সেরিব্রাল পালসি-আক্রান্ত ২৩ বছরের দেবাশিস হাইড্রোসিফালাস-এরও শিকার। মস্তিষ্কে জল জমে যাচ্ছে তাঁর। দেহের বাঁ দিকটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। এ হেন মানুষের লেখা প্রথম বই, ‘আমার মনের কল্পনা ও আশা’ রাজ্যের সমস্ত সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের গ্রন্থাগারে রাখার জন্য মনোনীত হয়েছে। প্রত্যেকটি সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলকে এই মর্মে বিজ্ঞপ্তিও পাঠিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকারের গ্রন্থাগার দফতর।
লেখায় ব্যস্ত দেবাশিস দাস।—নিজস্ব চিত্র
গ্রন্থাগারমন্ত্রী আব্দুল করিম চৌধুরীর কথায়, “স্কুল লাইব্রেরির জন্য বই বাছাই করতে আমাদের আলাদা কমিটি রয়েছে। তারা সব সময় চেষ্টা করেন এমন বই বাছতে, যাতে ছেলেমেয়েদের মনের বিকাশ হয়, তারা উৎসাহিত হয়।” মন্ত্রী জানালেন, দেবাশিসের বই থেকে ছাত্রছাত্রীরা বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাবে। আবার প্রতিবন্ধীদের সমানাধিকার, তাঁদের সম্মান করার বিষয়গুলিও তাদের ভাবাবে। সে জন্যই বইটি বাছাই করা হয়েছে।
দুই দিদির অনেকটা পরে জন্মানো ছোট ভাই দেবাশিস কিন্তু জন্মেছিলেন একেবারে সুস্থ-স্বাভাবিক হিসাবেই। হঠাৎ ধুম জ্বর এল জন্মের ১৭ দিনের মাথায়। বারেবারে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি করা হলে জানা গেল, অজানা কোনও কারণে পক্ষাঘাতের শিকার হয়েছে দেবাশিসের মস্তিষ্ক। হাসপাতালে থাকতে হল প্রায় দু’মাস। তত দিনে মস্তিষ্কে জল জমা শুরু হয়েছে। এর পর দিল্লির এইম্স-এর চিকিৎসায় দেবাশিস প্রাণে বাঁচলেন বটে, কিন্তু প্রতিবন্ধী হয়ে গেলেন সারা জীবনের মতো।শুধু কী ভাবে যেন রক্ষা পেয়ে গেল তাঁর মস্তিষ্কের অনুভূতি আর ভাবনার কোষগুলি!
নিজে নিজে প্রায় কোনও কাজই করতে পারেন না দেবাশিস। স্পষ্ট করে কথা বলাও নয়। ভরসা করতে হয় বাবা অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার নিখিলেশ দাস ও মা স্বর্ণময়ীর উপর। কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত কোনও শব্দ লিখতে পারতেন না। তারাতলায় ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পালসি’-তে যেতেন, সেখানে মুখেমুখে পড়াশোনা করতেন শুধু এইটুকুই।
স্বর্ণময়ীদেবী বললেন, “২০০৯ সালের এক দিন আমার বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বিকানের থেকে ফিরে হঠাৎই ছেলে আমাকে বলল, ও লিখতে চায়। আমি অবাক! একটা ডায়রি আর পেন দিলাম ওকে। দেখলাম লিখতে চেষ্টা করছে, কিন্তু কলমটা নড়বড় করছে। আমি কলমটা একটু ধরতেই চমকে দিয়ে ও গোটা-গোটা হরফে লেখা শুরু করল। আমরা কোনও দিন ওকে যুক্তাক্ষর বা এমন শব্দচয়ন শেখাইনি। অথচ ও লিখল! সেই শুরু।”
প্রথম বইয়ের প্রথম সংস্করণ ইতিমধ্যে নিঃশেষ। বইমেলায় দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হয়েছে দেবাশিসের ‘আমার কল্পনায় স্বদেশ গড়া’।
কিন্তু দেবাশিস, জীবনের প্রতি তোমার কি কোনও বিতৃষ্ণা নেই? এক বারও মনে হয় না কেন আমারই এমন হল? থম মেরে যান কিছু ক্ষণ, আনমনে তাকিয়ে থাকেন অপলক। তার পর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে জীবনের অস্পষ্ট কথা বলতে থাকেন রবীন্দ্রনাথের গানে ‘...বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ।’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.