রাজ্যের ‘অস্তিত্বহীন’ লক্ষাধিক মানুষ এ বার স্বীকৃতির আর্জি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ।
গঙ্গার ভাঙনে হারিয়ে গিয়েছে মালদহের ৬৪টি মৌজার প্রায় ২৬৭ বর্গ কিলোমিটার জমি আর সরকারি নথি থেকে মুছে যাওয়া লক্ষাধিক মানুষ। ভাঙনের পরে জেগে ওঠা চরে আশ্রয় নেন ভিটেমাটি-চাষজমি হারানো বিপন্নেরা।
এই ভাবে এক-এক জন যে কত বার ভিটেচ্যুত হয়েছেন, নিজেরাই তার হিসেব রাখতে পারেন না। স্থায়ী ঠিকানার খোঁজে দৌড়ে বেড়ান চর থেকে চরে। গঙ্গার বুকে দ্বীপের মতো ভেসে ওই সব চরে অন্তত ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের বাস, যাঁদের সিংহ ভাগই মুসলমান। কিন্তু চরগুলিকে পশ্চিমঙ্গের ভূখণ্ড বলেই মানতে নারাজ রাজ্য সরকার। চরের বাসিন্দারা যেন কার্যত ‘অস্তিত্বহীন’। ফলে তাঁদের নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার দায়ও কারও নেই। রাজ্যের এই অনীহা এবং অবজ্ঞার সুযোগে ঝাড়খণ্ড বরং ওই সব চরে দখল কায়েম করতে ব্যস্ত।
মালদহের চরবাসীদের সংগঠন ‘গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি’র পক্ষে সম্প্রতি হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন আইন আধিকারিক তথা পরিবেশ-কর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। তাঁর আর্জি, সমস্ত ভারতীয় নাগরিক যে সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার ভোগ করেন, তার সবই চরের বাসিন্দাদের দিতে হবে। এ ছাড়া, পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ডের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে সংবিধানের বিধি মেনে। |
বিশ্বজিৎবাবুর বক্তব্য, ‘‘চরে ডাকঘর, থানা-পুলিশ, প্রশাসন, ডাক্তার, স্কুল কিছুই নেই। শিক্ষার অধিকার আইন সেখানে প্রযোজ্য নয়। কোনও লাঞ্ছিতা নারীর বিচার চাওয়ার সুযোগ নেই। ফৌজদারি বিবাদ বা জমির বিবাদ মেটানোরও ব্যবস্থা নেই। নিরাপদ পানীয় জল পর্যন্ত নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে অস্তিত্বহীন ওই মানুষগুলোর ন্যূনতম স্বীকৃতি আদায়ের জন্যই এই জনস্বার্থ মামলা।’’
এই মামলার নথি তৈরি করতে বিশ্বজিৎবাবুকে সাহায্য করেছেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। তাঁর অভিযোগ, ‘‘গত পাঁচ দশক ধরে চরবাসীর দায় এড়িয়ে চলেছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যের কোনও মন্ত্রী বা আমলা কোনও দিন চরে পা রাখেননি। বহু আবেদন-নিবেদনেও সাড়া মেলেনি। আদালত হয়তো এ বার হতভাগ্য মানুষগুলোকে প্রকৃত নাগরিকের মর্যাদা দেবে।’’
উদ্যোগের এই সূচনাতেই খুশি ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য, সত্তরোর্ধ কেদারনাথ মণ্ডল। তাঁর গোঁসাইপুরের বাড়ি ভাঙনে তলিয়ে গিয়েছিল চল্লিশ বছর আগে। তার পরেও ভাঙন তাঁকে আরও চার বার ভিটেছাড়া করেছে। আপাতত তাঁর ঠিকানা সুকুল্লাপুর ঘোষপাড়া। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ফরাক্কা ব্যারাজ তৈরির পর থেকেই ভাঙন ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। চোখের সামনে তলিয়ে গিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। চরে বাস করা ভিটে হারানো মানুষগুলোকে সরকারও বঞ্চিত করেছে।’’
মালদহের গঙ্গার চরকে বলে ‘দিয়াড়া’। পাড় ভাঙলে নদীর ভিতরে যে চরগুলি জেগে ওঠে, সেগুলি যেন কোন সুদূরের দ্বীপ। বানুটোলা, খাটিয়াকানা, হারুটোলা, কাতলামারি, মাঙ্গাতপুর গ্রামগুলি একদা ছিল মূল ভূখণ্ডে। সব ভেঙে নদীতে তলিয়ে যায়। পরে ওই সব গ্রামের মানুষ নতুন চরে এসে পুরনো নামেই বসত পত্তন করেন। চরে সবই পুরনো নামের। কিন্তু গত চার দশকে বহু গ্রামের নাম সরকারি নথি থেকে মুছে গিয়েছে। মালদহ জেলার তিনটে আস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত এখন সরকারি নথিতে ‘অস্তিত্বহীন’।
শীতে গঙ্গার জল যখন সবচেয়ে কম, তখনও বাঙিটোলার পাগলাঘাট থেকে ভুটভুটিতে সেই রকম চরে ঘণ্টাখানেকের আগে পৌঁছনো যায় না। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে সারা দিনে একটা বা দু’টো ফেরি কিংবা খেলনার মতো ছোট ডিঙি (স্থানীয় নাম খোসা)। মানুষ বেঁচে থাকে প্রকৃতির ভরসায়।
জনস্বার্থ মামলা কি তাঁদের রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আর নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারবে? |