বিশ্ববিদ্যালয় জীবনশিক্ষার পীঠস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর জীবন বহুবিধ বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়। তাই সেখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময় চাই, সংস্কৃতি চর্চার অবকাশ চাই, উত্সব-ব্যসনের বন্দোবস্ত চাই। তবে এত কিছুর পাশাপাশি একটি নিভৃত প্রশ্ন গুঞ্জরিতে থাকে: বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কিছু বিদ্যাশিক্ষাও চাই? চাহিলে, তাহার স্থান হইবে কোথায়? খোদ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সে দিন এই প্রশ্নের নির্দ্বিধ উত্তর সরবরাহ করিল: বিদ্যাশিক্ষা চলিতে পারে, যদি নৃত্যগীতাদির পর সময় কিংবা সুযোগ থাকে, তবেই। রাজনীতি-সংস্কৃতি-উত্সবই প্রধান, মুখ্য, জরুরি। বিদ্যালাভ অপ্রধান, গৌণ, এলেবেলে। তাই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট প্রাঙ্গণে দোল উদ্যাপনের আনন্দমুখর ধ্বনিসমুদ্রে ডুবিয়া গেল শ্রেণিকক্ষের পাঠ, এমনকী সন্নিহিত বিদ্যালয়ের অসংখ্য কিশোর উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মনঃসংযোগের ব্যর্থ প্রয়াস। ছয়-ছয়টি লাউডস্পিকার কাঁপাইয়া তুলিল কলেজ স্ট্রিটের ধরণীতল, তাহাদের সহর্ষ সুরমূর্ছনায় গোটা অঞ্চল জুড়িয়া পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা-চিত্রের করুণ অবস্থা যেন প্রতিধ্বনিত হইল।
রাজ্যের হাই কোর্টের কড়া নির্দেশ: পরীক্ষা চলাকালীন গণস্থানে লাউডস্পিকার ব্যবহার করা চলিবে না। নির্দেশিকায় ইহাও স্পষ্ট, কোনও ব্যতিক্রমই চলিবে না, পাশাপাশি যদি কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকে তবেও ব্যতিক্রম ঘটানো যাইবে না। কিন্তু সে দিন অবশ্যই আদালতের নির্দেশনামাকে উত্সব-বিধুর ছাত্রসমাজ পাত্তা দিবার যোগ্য মনে করে নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কক্ষ হইতেও নাকি বারংবার অনুরোধ-আদেশ পৌঁছাইয়াছে তাহাদের নিকট, অবস্থার পরিবর্তন হয় নাই। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ শুনিবার বাধ্যতা তো তাহাদের নাই, থাকিতে পারে না, কেননা তাহারা একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা, এবং সেই রাজনৈতিক দলই যে ঘটনাচক্রে এ রাজ্যের বর্তমান সর্বেসর্বা শাসক দল। কোনও আদালত কিংবা উচ্চ-কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাই নাই এই রাজ-আশীর্বাদ-ধন্য ছাত্র পরিষদকে আদেশ কিংবা উপদেশ দিয়া অসম্মান করিবার। এ সকলই পরিচিত গল্প। পশ্চিমবঙ্গ হাড়ে হাড়ে জানে, শাসক দল দ্বারা পরিচালিত হইলে কিংবা শাসক দলের কৃপাদৃষ্টি থাকিলে, সাত কেন, সাতশো অপরাধ দর্পিত দাপটে চলিতে পারে। এ রাজ্যে এই দস্তুর গত কয়েক দশক ধরিয়াই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দস্তুরও তো বহু-ব্যবহারে আশ্চর্য দক্ষতায় পরিণত হয়। তবে কিনা, সরকারি আশিস-বলে বলীয়ান হইয়া এই ছাত্র সংসদ যে কেবল নৃত্যগীতে শহর মাতাইয়াছে, চাকু কিংবা বোমা বাহির করিয়া রক্তবন্যা বহায় নাই, ইহাই কি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অশেষ সৌভাগ্য নহে? পরীক্ষার্থীদেরও বুঝিতে হইবে, পরীক্ষা পাশ করিলেই যে সতত-উত্সব-মুখর কোলাহলসর্বস্ব পৃথিবী তাহাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছে, তাহার হাল-হকিকতে অভ্যস্ত হওয়াও পরীক্ষারই অঙ্গ। কোন উত্তাল শিক্ষাজগতে পা রাখিবার জন্য তাহারা পরীক্ষা দিতেছে, এই অভিজ্ঞতা তো তাহারই প্রস্তুতি! |