করুণানিধি তামিল তাস খেলিলে জয়ললিতা কি চুপ থাকিতে পারেন? ডিএমকে-র ইউপিএ ত্যাগের মহিমাকে ধুলায় মিশাইয়া দিতে তিনি ফরমান জারি করিলেন, তাঁহার রাজ্যে আইপিএল-এর যে দশটি খেলা হইবে, তাহাতে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা অংশগ্রহণ করিতে পারিবেন না। শুধু খেলোয়াড়রাই ব্রাত্য নহেন, আম্পায়ার, ম্যাচ আধিকারিক, ক্রীড়া সহযোগী শ্রীলঙ্কার পাসপোর্ট থাকিলেই তামিলনাড়ুতে প্রবেশ নিষেধ। তাঁহার রাজ্যে নাকি শ্রীলঙ্কা-বিরোধী আবেগ এখন এতই চড়া যে তাঁহাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হইবে না। অতএব, চেন্নাইয়ে খেলিতে হইলে শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়দের বাদ রাখিয়াই খেলিতে হইবে। তাঁহার এই অন্যায় আবদারটি আইপিএল কর্তৃপক্ষ তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও মানিয়া লইয়াছেন। রাজনীতির হাতে খেলা, এবং খেলার বিশ্বজনীন দর্শনটি মারা পড়িল।
নিরাপত্তার অভাবের অজুহাতটি যে অজুহাতমাত্রই, জয়ললিতাও তাহা গোপন করিবার চেষ্টা করেন নাই। ডিএমকে-প্রধান করুণানিধির পৌত্র কালনিধি মারানের সানরাইজার্স হায়দরাবাদ দলে কেন এখনও শ্রীলঙ্কার দুই ক্রিকেটার আছেন, তিনি সেই প্রশ্ন তুলিয়াছেন। ভারতের দুর্ভাগ্য, জয়ললিতার ন্যায় রাজনীতিকরাই এই দেশে ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত। খেলা আর রাজনীতি যে দুইটি পৃথক ময়দান, তাঁহারা সেই কথাটি বুঝিয়াও বুঝেন না। যে খেলার কাজ বিভেদ মুছিয়া দেওয়া, তাঁহারা সেই খেলাকেই বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার করিয়াছেন। বস্তুত, জয়ললিতা পূর্বেও খেলার সহিত রাজনীতিকে মিশাইয়াছেন। তাঁহার আপত্তিতেই চেন্নাইয়ে এশিয়ান অ্যাথলেটিকস মিট অনুষ্ঠিত হয় নাই। কলম্বোর একটি ফুটবল দল চেন্নাইয়ে খেলিতে পারে নাই। অনুমান করা চলে, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা যেমন পাকিস্তানি ক্রিকেট বা হকি দলকে খেলিতে না দিয়া সস্তা হাততালির রাজনীতি করে, তামিলনাড়ুতে জয়ললিতাও সেই মডেলই অনুসরণ করিতে চাহিতেছেন। দুর্ভাগ্য ভারতের।
প্রশ্ন কেবল চেন্নাইয়ের শাসক সম্পর্কে নয়, প্রশ্ন দিল্লীশ্বর সম্পর্কেও। জয়ললিতা তামিল ভোটের সমীকরণ সাজাইতে চরম অন্যায় আবদার করিতে পারেন, মনমোহন সিংহ সেই আবদার মানিবেন কেন? জয়ললিতার সিদ্ধান্তটি পত্রপাঠ নাকচ করিয়া দেওয়াই বিধেয় ছিল। যে রাজ্য প্রশাসক কতিপয় খেলোয়াড়ের নিরাপত্তাবিধান করিতে পারে না, তাহার খেলার আয়োজন করিবার যোগ্যতা নাই, এই সহজ কথাটি বলা যাইত না? চেন্নাই হইতে খেলা সরাইয়া দেওয়া, চেন্নাই সুপার কিংস-কে অন্যত্র ‘ঘর’ পাতিতে বলা অনেক কিছুই করিবার ছিল। প্রধানমন্ত্রী জোট রাজনীতির মালা জপিয়া নিশ্চুপ থাকিলেন। শ্রীলঙ্কায় তামিলদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যে অন্যায় করিয়াছে, তাহার সহিত খেলার বা খেলোয়াড়দের কোনও সম্পর্ক নাই, এই কথাটি দৃঢ় স্বরে বলিতে পারিলেন না। যে ক্ষমতার বিন্দুমাত্র দাঁত-নখ নাই, সেই ক্ষমতারও এত মোহ কীসের? আই পি এল কর্তৃপক্ষও চুপ করিয়া এই অন্যায় মানিয়া লইলেন। বিসিসিআই স্মরণে রাখুক, স্বশাসনের অধিকার কেবলমাত্র কিছু সুবিধা পাইবার জন্যই নহে ভ্রান্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার জন্যও বটে। তাহারা সে কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। রাজনীতির পরিহাস, এই সংকীর্ণতায় যে প্রতিযোগিতাটি কলঙ্কিত হইল, তাহার নাম আইপিএল। প্রতিযোগিতাটি জন্মলগ্ন হইতেই, ক্রিকেট লইয়া রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মাদনাকে বিদায় করিয়াছিল। দেশের গণ্ডি ভাঙিয়া ক্রিকেটকে তাহার দর্শকদের নিকট প্রকৃতার্থে বিশ্বজনীন করিয়াছিল। এক দিকে শহরভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দৌলতে দর্শক-আনুগত্যের নূতন সংজ্ঞা নির্মিত হইয়াছিল, অন্য দিকে দেশকে সমর্থন করিবার বাধ্যবাধকতা ভুলিয়া পছন্দের খেলোয়াড়ের জন্য গলা ফাটাইবার সুযোগ আনিয়া দিয়াছিল আইপিএল। খেলা যেমন হওয়া উচিত, আইপিএল ঠিক তেমনই হইয়াছিল। রাজনীতির যূপকাষ্ঠে সেই চরিত্রটি বলিপ্রদত্ত হইল। ভারতের ক্রীড়া-ইতিহাসে ইহা বড় লজ্জার দিন। |