বন্ধুত্বেরই বার্তা, তবে নিজের অসুবিধের উল্লেখটুকু না করে নয়।
এ জন্যই চিনের নতুন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদে বাঁধ দেওয়ার পরিণাম খতিয়ে দেখতে যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব দিলেন মনমোহন সিংহ। সেই প্রস্তাব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন জিনপিং।
তিব্বতের মানস সরেবর থেকে উৎপত্তি ব্রহ্মপুত্রের। সেখানে নিজেদের অংশে তিনটি বাঁধ তৈরি করতে চায় বেজিং। দিল্লির উদ্বেগ, এর ফলে ভারতে ব্রহ্মপুত্রের জল কমে যাবে। কিন্তু জিনপিংয়ের যুক্তি, আদৌ তা হবে না। এই তর্কের অবসান ঘটাতেই মনমোহনের প্রস্তাব, সমীক্ষা করে দেখা হোক বাঁধ তৈরির পরিণাম। সমীক্ষক দলে থাকুন দু’দেশের প্রতিনিধিরাই।
কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশের নতুন রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে এ কি সংঘাতের বার্তা? ডারবান থেকে ফিরতি বিমানে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, আদৌ তা নয়। গোটা সম্মেলনের কার্যক্রম ও দুই শীর্ষ নেতার মুখোমুখি বাক্যালাপের মুখ্য নির্যাসটি অবশ্যই সখ্যের। কিন্তু তা বলে প্রতিবেশীকে নিজের সুবিধে-অসুবিধেটুকু জানানো যাবে না?
ব্রিকস সম্মেলনে উজ্জ্বল উপস্থিতি, আর মনমোহন সিংহের সঙ্গে ‘হোলি-মিলন’। খুব কাছ থেকে দেখে চিনের নতুন প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের সম্পর্কে সাউথ ব্লকের এক কূটনীতিকের মন্তব্য, “হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, উনি যেন এই অঞ্চলের বারাক ওবামা! বাপরে, কী আত্মবিশ্বাস!”
কেন এমন বলছেন ওই কর্তা? |
প্রস্তাবিত ব্রিকস ব্যাঙ্কে কে কত টাকা দেবে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ভারত বলছে, সবাইকে ৫ কোটি ডলার করে দিতে হবে। চিনের প্রেসিডেন্ট আগ বাড়িয়ে বলে দিলেন, আমরাই ১০ কোটি ডলার দিয়ে দেব। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন ও দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকস-এর সদস্য এই ৫টি দেশ মিলে তৈরি করছে এই ব্যাঙ্ক। এরই নাম হচ্ছে ব্রিকস ব্যাঙ্ক। ডারবান ঘোষণায় এই ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার কথা জানিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু কে কত অর্থ ঢালবে, সেটা চূড়ান্ত হল না। কারণ রাশিয়া এই মুহূর্তে এত অর্থ ঢালতে রাজি নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়ে দিয়েছে, তাদের পক্ষে এত অর্থ দেওয়াই সম্ভব নয়। আর সব থেকে বেশি টাকা দিয়ে চিন এই পুরো ব্রিকস গোষ্ঠীর অগ্রজ হতে বিশেষ উৎসাহী। শুধু ডারবান ঘোষণা নয়, হাবেভাবে চালচলনে সেটা সকলকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন জিনপিং।
এর পরেও ভারত কিন্তু চিন তথা তার নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে বিশেষ উৎসাহ দেখিয়েছে। গত কাল চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্রে চিনের বাঁধ তৈরির প্রচেষ্টা নিয়েও আলোচনা করেছেন মনমোহন। কথা হয়েছে অন্য বকেয়া বিষয় নিয়েও। আবার এত দিন ধরে যে সব বিষয়ে ঢাক-ঢাক গুড়গুড় ছিল, সেই তিব্বতের মতো প্রসঙ্গও তুলতে ভোলেননি চিনের নতুন প্রেসিডেন্ট। দু’দেশের শীর্ষ নেতার মধ্যে প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। মনমোহন জিনপিংকে ভারতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই বছরে মনমোহনেরও চিনে যাওয়ার কথা। ড্রাগন বনাম হাতির লড়াইয়ের কাহিনি বহু প্রাচীন। কিন্তু ভারত এখন মনেপ্রাণে এই সংঘাতের আবহটিকে প্রশমিত করতে উদ্যোগী।
কিন্তু বিশ্ব ব্যাঙ্ককে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই যে ব্রিকস ব্যাঙ্ক তৈরি হচ্ছে। চিনের সঙ্গে ভারত আবার নতুন করে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে চাইছে। এগুলো কি আমেরিকার মনপসন্দ হবে? পরমাণু চুক্তি রূপায়ণের পর থেকে নানা কারণে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ইরান থেকে পাকিস্তান, নানা বিষয়ে মার্কিন দাদারা নয়াদিল্লির ওপর ক্ষুব্ধ। এই পরিস্থিতিতে চিনের সঙ্গে এই নতুন সখ্য আমেরিকাকে আরও রুষ্ট করে তুলবে না তো!
এই প্রশ্নের জবাবে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বলেন, “ভারত এটাকে কোনও আলাদা কূটনৈতিক অক্ষ হিসেবে দেখছে না। আমেরিকা নিজেও তো চিনের সঙ্গে প্রচুর বাণিজ্য করছে। রাশিয়া ও ব্রাজিলও করছে। কিন্তু এই পাঁচটি দেশ, তাদের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য একত্রিত হলে সকলেরই আরও ভাল হতে পারে।”
আর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তো ব্রিকস সম্মেলনে বলেই দিলেন, বিশ্ব আর্থিক মন্দায় ব্রিকস দেশগুলির অর্থনৈতিক বিকাশ দুনিয়ার সঙ্কট মোচনেও সাহায্য করবে। সুতরাং ব্রিকস-কে একটি চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে ব্যবহার করতে ভারতের উৎসাহ এই মুহূর্তে কোনও অংশে কম নয়। তবে ভারত এ-ও চাইবে না যে ব্রিকস-কে ব্যবহার করে চিন এই অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠুক। দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাহায্যের ক্ষেত্রে চিন কার্যত হরির লুট দিচ্ছে। বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে রাস্তাঘাট, সবই তারা করে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আবার দক্ষিণ আফ্রিকায় চিনের এই অতি-সক্রিয়তায় মোজাম্বিকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কার্যত চিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছে সেখানে। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ইনস্টিটিউট অফ সাউথ আফ্রিকান স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক আদামা গায়ে তাঁর বই ‘চায়না-আফ্রিকা: দ্য ড্রাগন অ্যান্ড দ্য অস্ট্রিচ’-এ চিনের এই দাদাগিরির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। মনমোহন সিংহ তাই এক দিকে নয়া পঞ্চশীল নীতি নিয়ে এগোচ্ছেন। কারণ এ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প রাস্তা খোলা নেই। রিচার্ড নিক্সন এবং হেনরি কিসিংগার-ও চিনের সঙ্গে বরফ গলিয়ে সাফল্য পেয়েছিলেন। ওবামাও চিন সফর করেছেন। আর চিনের পাশাপাশি আমেরিকার সঙ্গেও সম্পর্ক অটুট রাখতে চাইছেন মনমোহন। সেই ভারসাম্যের কূটনীতি। যা আগেও বিশেষত্ব ছিল ভারতের বহুস্তরীয় বিদেশনীতির।
|