পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারির চার দিনের মাথায় অবস্থান আরও একটু নরম করল রাজ্য সরকার। কোথায় কবে ভোট হবে, দীর্ঘ টানাপোড়েনের পরে তার পুনর্বিন্যাস করল তারা। তাদের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের যে যুদ্ধের আবহ তৈরি হয়েছিল, এই সিদ্ধান্তের পরে সেই দমবন্ধ পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হল বলে মনে করছে প্রশাসনিক মহল। অনেকে আশা করছেন, এ বার জট খোলার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পুরো ঘটনাটিতে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন মধ্যস্থতা করায় এবং দিনের শেষে সরকার ‘আরও আলোচনার অবকাশ রয়েছে’ বলে মন্তব্য করায় এই ধারণা দৃঢ় হয়েছে। তবে অন্য একটি পক্ষের মত, না আঁচানো পর্যন্ত বিশ্বাস নেই। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে কমিশনের মত এখনও মানেনি রাজ্য। অথচ কমিশন এ দিনও ব্যাখ্যা দিয়েছে, কেন কেন্দ্রীয় বাহিনী দরকার। আজ, বুধবার দোল। রাজ্য সরকারের পরিবর্তিত চিঠি খতিয়ে দেখে আগামিকাল, বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে ঘোষণা করেছে কমিশন। তত ক্ষণ পর্যন্ত চাপা উত্তেজনাটা থাকবেই বলে মনে করছে প্রশাসনের একটি অংশ।
তবে একটা বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত। সেটা হল, শুক্রবার থেকে যে অনমনীয় মনোভাব নিয়ে চলছিল রাজ্য সরকার, এ দিন তাতে বদল এসেছে। অনেকে বলছেন, বিজ্ঞপ্তিতে পরিবর্তন হয়েছে হয়তো সামান্যই। কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে সেটা অনেকখানি। আগের বিজ্ঞপ্তিতে দু’দিনের ভোটে এক দিন কংগ্রেস প্রভাবিত তিন জেলা ও অন্য দিন বাকি রাজ্যকে রেখেছিল সরকার। এই বিন্যাস রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল সব মহলে। সোমবার নির্বাচন কমিশন রাজ্যকে যে চিঠি দেয়, সেখানেও অন্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি এমন সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
এ দিন প্রথম বার সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়ে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় কমিশনের সেই চিঠিকে বালকোচিত বলে উল্লেখ করেন। বলেন, ১১ পাতার চিঠির সাড়ে ১০ পাতাই অবাস্তব এবং অবান্তর। কিন্তু এর এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁর শরীরী ভাষা বদলে যায়। প্রথমে জেলা পুনর্বিন্যাসের কথা ঘোষণা করেন তিনি। জানান, প্রথম পর্বে দক্ষিণবঙ্গ এবং দ্বিতীয় পর্বে উত্তরবঙ্গ ও মুর্শিদাবাদে ভোট।
দু’দফার সাংবাদিক বৈঠকের মধ্যে সুব্রতবাবু তথা সরকারের সুর বদল হল কেন? মহাকরণের আমলাদের অনেকেই মনে করছেন, এর পিছনে রয়েছেন খোদ রাজ্যপাল। একটি সূত্রের বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে অচলাবস্থা কাটাতে এর আগে থেকেই মধ্যস্থতা করছিলেন নারায়ণন। তখন মনে হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত রফায় পৌঁছনো সম্ভব হবে। তার পরে গত শুক্রবার যখন রাজ্য সরকার একতরফা ঘোষণা করে কমিশনের কোর্টে বল ঠেলে দেয়, তখন ফের তৈরি হয় অচলাবস্থা।
এই পরিস্থিতিতে সোমবার রাজ্যের প্রস্তাব খারিজ করার সঙ্গে সঙ্গে পর দিনই রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। সেই মতো এ দিন সকালে রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালকে পরিস্থিতি জানিয়ে আসেন তিনি। মহাকরণ সূত্রের খবর, প্রথম দফার সাংবাদিক সম্মেলনের পরেই সুব্রতবাবুর কাছে রাজ্যপালের ফোন আসে। ফোনে কথা বলার পরে পঞ্চায়েতমন্ত্রী চলে যান মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। এর পরেই ভোটের এলাকা বিন্যাস নিয়ে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত বদল। দোলে পুরী যাচ্ছেন সুব্রতবাবু। সেখান থেকে ফিরে এসে শুক্রবার তিনি রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলতে যাবেন বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত বদল কতটা গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, জেলার বিন্যাস বদলালেও ভোট সেই দুই পর্বেই রেখেছে সরকার। তেমনই জানিয়ে দিয়েছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর কোনও প্রশ্নই নেই। যা দেখেশুনে কমিশনের মধ্যে থেকেই প্রশ্ন, দ্বিতীয় পর্যায়ের বিজ্ঞপ্তি জারির আগেও কেন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করল না রাজ্য? কমিশনের একটি সূত্র বলেন, আইন অনুযায়ী রাজ্য সরকার শুধু দিন ঠিক করে দেবে। কোথায়, কবে নির্বাচন হবে, তা ঠিক করবে নির্বাচন কমিশন। একই ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী কেন প্রয়োজন, আবার তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন কমিশন সচিব তাপস রায়। তিনি বলেন, “গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় বুথের সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজারের কিছু বেশি। এ বার তা বেড়ে হয়েছে ৫৭ হাজার ১৫। যা গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায়ও বেশি।” তাঁর বক্তব্য, “শুনেছি গত বিধানসভা নির্বাচনে ৬৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা চেয়েছি ৮০০ কোম্পানি। তবে এটা বলতে পারি, দফা যত বাড়বে নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজনীয়তাও তত কমবে।” সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিশন যদি এই দাবি নিয়ে রাজ্যপালের কাছে দরবার করে, তা হলে তিনি রাজ্যকে নির্দেশ দিতে আইনত বাধ্য। রাজ্যের প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমও বলেছেন, কমিশন বললে রাজ্যপালকে তা মেনে নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও অন্য একটি পক্ষ কিন্তু বলছে, যে দমবন্ধ অনমনীয় পরিস্থিতি গত চার দিন ধরে চলেছে, তাতে সরকারের এটুকু বদলও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। বিশেষ করে, সুব্রতবাবুর শরীরী ভাষার বদল তারই ইঙ্গিতবাহী। এক ঘণ্টা আগে পঞ্চায়েতমন্ত্রী কমিশনের চিঠি প্রসঙ্গে বলেছেন, “কেন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে (সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে), সেটাই দুর্বোধ্য। নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করছে।” বলেছেন, “কাল উনি (রাজ্য নির্বাচন কমিশনার) রাষ্ট্রপতির কাছেও যেতে পারেন।” রাজ্যপাল কি মধ্যস্থতা করবেন এই প্রশ্নের জবাবে সুব্রতবাবুর মন্তব্য ছিল, “প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, সব কথা আইনেই বলা আছে। আমরা কিছু বলছি না।” এক ঘণ্টা পরে শুধু জেলা পুনর্বিন্যাসের কথা ঘোষণাই নয়, সুব্রতবাবু জানান, “আমরা তো এক দিনে ভোট করতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, রাজ্যের পুলিশ দিয়ে নির্বাচন করব। কমিশনের বক্তব্যের পরে দু’দিনে ভোট ঘোষণা করি। বলেছিলাম ভিন রাজ্য থেকে সশস্ত্র পুলিশ আনব। ফের নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যের পরে আমরা ভোটের জেলা বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়েছি।” এবং শেষে বলেন, “আরও আলোচনার অবকাশ রয়েছে।”
রাজ্য কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কাছে নতিস্বীকার করল? সুব্রতবাবু বলেন, “আপনারা কী লিখবেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার। কোথাও যাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়, তার জন্য আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” নতুন সিদ্ধান্ত জানিয়ে সন্ধ্যায় কমিশনকে চিঠিও পাঠিয়ে দেয় রাজ্য। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের এক পদস্থ কর্তার মন্তব্য, “নির্বাচন কমিশনের মতামতের ভিত্তিতেই রাজ্য সরকার নিজেদের অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। এ বার বল কমিশনের কোর্টে। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে মতানৈক্যও আলোচনায় কেটে যাওয়া উচিত।”
আর কমিশনের সচিব বলেন, “রাজ্য যে আমাদের প্রস্তাব কিছুটা হলেও পর্যালোচনা করেছে, তা বুঝতেই পারছি। দ্বিতীয় দফায় ভোটে নতুন জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নিশ্চয়ই কমিশন বিবেচনা করবে।” তিনি জানান, “চিঠির ভাষা দেখে তার পর সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।”
তবে কমিশন সূত্রে আরও একটি চিন্তার বিষয় রয়েছে। তারা জানিয়েছে, ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত কত দিন পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারির পরে মনোনয়ন পেশ, স্ক্রুটিনি ও নাম প্রত্যাহার মিলিয়ে ১০টি কাজের দিন দরকার। শনি-রবি ধরলে মোট ১২ দিন। পঞ্চায়েত ভোট ব্যালটে হয়। বিপুল পরিমাণ ব্যালট ছাপতে লাগবে অন্তত ১৫ দিন। সব মিলিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৭ দিন দরকার। সরকারের তারিখ মেনে নিয়ে বৃহস্পতিবার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হলে টায়-টোয় ২৮-২৯ দিনই হাতে থাকছে, যার মধ্যে কাজ শেষ করা খুবই কঠিন।
সরকারের অবস্থান বদলকে বিরোধীরা কী চোখে দেখছেন? প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “এই সিদ্ধান্ত খতিয়ে দেখব। তবে জেলা পুনর্বিন্যাসের অধিকার রাজ্য সরকারের নেই।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “আমরা চাই, সংঘাত মিটিয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভাবে পঞ্চায়েত ভোট হোক।” সুব্রতবাবু যে ভাষায় এ দিন কমিশনকে আক্রমণ করেছেন, তার সমালোচনা করে সূর্যবাবুর বক্তব্য, “মন্ত্রী তো দূরের কথা, সাংবিধানিক পদ সম্পর্কে কোনও ভদ্র মানুষেরই এ ভাবে কথা বলা উচিত নয়।” বিজেপি কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে তিন দফায় ভোটের দাবিতে অনড়। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “কমিশন কী অবস্থান নেয় দেখে নিই। তিন দফায় আধা সামরিক বাহিনী দিয়ে ভোট না হলে মামলার পথেই যেতে হবে আমাদের।”
দিনভর টানাপোড়েনের পরে সন্ধ্যায় দফতর ছাড়ার সময় মীরাদেবী বলে যান, “আমরা রাজ্য সরকারের চিঠি পেয়েছি। ওই চিঠির বয়ান পর্যালোচনা করে দু’-এক দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত মত জানাব।” রাজ্য সরকার কি তাদের অবস্থান থেকে নরম হয়েছে? মীরাদেবী বলেন, “কোনও মন্তব্য করব না।” এর পরেও কি আপনারা আইনের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবছেন? এ বারও তাঁর বক্তব্য, “এ নিয়েও কোনও মন্তব্য করব না।”
মীরাদেবীর উল্টো দিকে যিনি রয়েছেন, সেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি। সন্ধ্যার মুখে মহাকরণ ছাড়ার আগে সবাইকে হোলির শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “এই বিষয়ে আমি কিছু বলব না। যা বলার সুব্রতদা বলছেন।”
|
২০০৮ কী হয়েছিল |
• ৩-৪ মাস আগে থাকতে রাজ্য-কমিশন ফোনে কথা
• পরীক্ষা, বড় সরকারি কর্মসূচি আছে কি না দেখা
• দিন চূড়ান্ত করতে পঞ্চায়েত সচিব-কমিশন এক দিনই কথা
• ভোটের দিন ঘোষণা করে রাজ্যের বিজ্ঞপ্তি
• তার পর ভোটের নির্ঘণ্ট জানিয়ে কমিশনের বিজ্ঞপ্তি
• নির্বাচনী আচরণবিধি কার্যকর
• জেলা প্রশাসনের সহায়তায় কমিশনের ভোট পরিচালনা
১৯৯৪-এ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের জন্মলগ্ন থেকে এটাই চলে আসছে |
|