রাজনীতির হাড়িকাঠে ফের বলি হল ক্রিকেট।
ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক টানাপোড়েনের জেরে চার বছর আগে থেকেই আইপিএলে ব্রাত্য পাক ক্রিকেটাররা। সইদ আজমল, শাহিদ আফ্রিদিরা আইপিএলে আজও নেই। সেই এক বন্ধনীতে এ বার ঢুকে পড়ল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটও।
আইপিএল সিক্সে শ্রীলঙ্কার কোনও ক্রিকেটার চেন্নাইয়ে ঢুকতে পারবেন না। অর্থাৎ মাহেলা জয়বর্ধনে, কুমার সঙ্গকারা বা মুথাইয়া মুরলীধরনদের কোনও অবস্থাতেই দেখতে পাচ্ছে না চিপক। আর এটা ঘটছে কোথায়? খোদ বোর্ড প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসনের নিজের শহরে!
ঘটনার কেন্দ্রে যদিও ক্রিকেট, তবে কারণটা একেবারেই অক্রিকেটীয়। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে লিখিত ভাবে জানিয়ে দেন, তাঁর রাজ্যে যে ভাবে শ্রীলঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে কোনও অবস্থাতেই তিনি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের চেন্নাইয়ে ঢুকতে দেবেন না। চেন্নাইয়ে ম্যাচ আয়োজনের যে শর্ত জয়ললিতা দিয়েছেন, তা এ রকম চেন্নাই তো বটেই, বাকি ফ্র্যাঞ্চাইজিদেরও কেউ শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের সঙ্গে আনতে পারবে না। শুধু তা-ই নয়, চিপকে থাকতে পারবেন না শ্রীলঙ্কার আম্পায়ার, ম্যাচ অফিশিয়াল বা সাপোর্ট স্টাফেরাও। |
জয়ললিতার এই ঘোষণার ঘণ্টাখানেক পরেই বৈঠকে বসে আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিল। এবং বৈঠক শেষে যাবতীয় জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঘোষণা করে দেয়, চেন্নাইয়ের ম্যাচে শ্রীলঙ্কানদের খেলানো যাবে না। আইপিএল সিক্সের ন’টি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে এই কথা জানিয়ে দেওয়া হবে।
আইপিএল সিক্সে চেন্নাই পেয়েছে মোট দশটি ম্যাচ। চেন্নাই সুপার কিংসের আটটি হোম ম্যাচ-সহ দু’টি এলিমিনেটর। টুর্নামেন্টে খেলছেন শ্রীলঙ্কার মোট তেরো জন ক্রিকেটার। যাঁদের মধ্যে মাহেলা জয়বর্ধনে এবং কুমার সঙ্গকারা যথাক্রমে তাঁদের ফ্র্যাঞ্চাইজি দিল্লি ডেয়ারডেভিলস এবং সানরাইজার্স হায়দরাবাদের অধিনায়ক। বাকিদের মধ্যে নামী তারকা বলতে রয়েছেন মুথাইয়া মুরলীধরন এবং তিলকরত্নে দিলশান (রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু), অজন্তা মেন্ডিস এবং অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজ (সহারা পুণে ওয়ারিয়র্স), লাসিথ মালিঙ্গা (মুম্বই ইন্ডিয়ান্স) এবং নুয়ান কুলশেখরা (চেন্নাই সুপার কিংস)। একমাত্র কিংস ইলেভেন পঞ্জাবেই কোনও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার নেই।
তবে প্রশ্ন থাকছে, লিগ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের না খেলানোর প্রস্তাবে রাজি হলেও এলিমিনেটরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তারকা প্লেয়ারদের বাদ দিতে রাজি না-ও হতে পারে ফ্র্যাঞ্চাইজিরা। সে ক্ষেত্রে ২১ এবং ২২ মে-র দু’টি এলিমিনেটর অন্য শহরে সরানো হতে পারে বলে বোর্ড সূত্রের খবর।
যে আইপিএল কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি এত রকম বিকল্প বন্দোবস্ত ভেবে রাখলেন, তার চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল কিন্তু মাত্র দিন কয়েক আগে চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী সুরে বলেছিলেন, “চেন্নাইয়ে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের খেলা নিয়ে কোনও আশঙ্কা নেই। খেলা চলাকালীন কোনও সমস্যা হলে পরিস্থিতি বিচার করে দেখা যাবে।” সেই রাজীবই এ দিন একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে বলে দিয়েছেন, “তামিলনাড়ুতে চলতি উত্তেজনার প্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসনই যখন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে, তখন আর ঝুঁকি নেওয়া যায় না। টিম মালিকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। দু’টো জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হয়েছিল। স্থানীয় আবেগ এবং শ্রীলঙ্কানদের নিরাপত্তা। স্থানীয় প্রশাসন কোনও প্রস্তাব দিলে তো শুনতেই হবে। কারণ ম্যাচ আয়োজনে ওদের সাহায্য দরকার।”
আইপিএল চেয়ারম্যানের ব্যাখ্যা যা-ই হোক, বোর্ডের এই সিদ্ধান্তের পিছনে কেউ কেউ নিরাপত্তার চেয়ে জোট রাজনীতির চিন্তাই দেখছেন বেশি। ক’দিন আগে আর এক তামিল নেতা করুণানিধি শ্রীলঙ্কা প্রশ্নেই সমর্থন তুলে নিয়ে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছেন কেন্দ্রকে। লোকসভা ভোটের আগে বিধ্বস্ত ইউপিএ সরকার এ বার জয়ললিতার চাপের কাছে নতিস্বীকার করল কি না, সেই প্রশ্ন স্বভাবতই উঠেছে। ভারতে শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার প্রসাদ কারিয়াওয়াসাম যেমন খোলাখুলিই বলেছেন, “খেলা আর রাজনীতিকে মেশানো উচিত নয়।” আইপিএল চেয়ারম্যান রাজীব শুক্ল নিজেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ায় চাপের রাজনীতি নিয়ে জল্পনা বেড়েছে। রাজীব যদিও বলছেন, “মাথা নত করার প্রশ্ন নেই। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের হাতে। রাজ্য সরকার আপত্তি করলে আমাদের তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।”
কিন্তু অনেকেরই মতে, সাউথ ব্লকের কর্তারাও চান না মুরলী-সঙ্গকারাদের খেলা নিয়ে চেন্নাইয়ে নতুন করে অশান্তি তৈরি হোক। কেন্দ্রের এক শীর্ষ মন্ত্রী জানান, শুধু আইপিএল নিয়ে সমঝোতা নয়, দ্রাবিড়-রাজনীতির কথা মাথায় রেখে শ্রীলঙ্কায় আসন্ন ‘চোগাম’ (কমনওয়েলথ হেডস অফ গর্ভনমেন্ট) সম্মেলনেও হয়তো এ বার না-ও যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। সোমবারই প্রথমে করুণানিধি বলেছিলেন, শ্রীলঙ্কায় তামিল হত্যার বিরোধিতা করে নভেম্বরে কলম্বোয় ওই সম্মেলন বয়কট করতে হবে ভারতকে। তার পর চিঠিতে একই দাবি জানিয়েছিলেন জয়ললিতা। কংগ্রেসের ওই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, লোকসভা ভোটের আগে কোনও একটি দ্রাবিড় দলের সঙ্গে সমঝোতা করতেই হবে কংগ্রেসকে। সে ক্ষেত্রে তাদের এই দাবিও মেনে নেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আপাতত কোপ নামল ক্রিকেটে। যা অবস্থা, তাতে চেন্নাইকে ঘিরে রাজনীতির আইপিএল-ও একই সঙ্গে চালু হয়ে গেল!
|