চাষের জন্য ছোট বাঁধ গড়া, কুয়ো খোঁড়া, ছোটখাটো খাল সংস্কারের বেশি অভিজ্ঞতা নেই। বীজ, ধানঝাড়া যন্ত্র, ট্রাক্টর নিয়েই মূলত কারবার। এমনই এক সরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হল প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার রাস্তা গড়ার দায়িত্ব। বাম-পরিচালিত হাওড়া জেলা পরিষদের হাত থেকে ওই দায়িত্ব কেড়ে তা দেওয়া হয়েছে রাজ্য কৃষি-শিল্প নিগমকে (ওয়েস্টবেঙ্গল অ্যাগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন)। খোদ পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, নিগমের চেয়ারম্যান
তথা রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধের ভিত্তিতেই ওই দায়িত্ব জেলা পরিষদের হাত থেকে সরানো হয়েছে।
জেলা পরিষদের মতো নির্বাচিত স্বশাসিত সংস্থার এক্তিয়ারে এ ভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা যায় না বলে পঞ্চায়েতমন্ত্রীকে ইতিমধ্যেই চিঠি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে হাওড়া জেলা পরিষদ। জেলা সভাধিপতি সিপিএমের মীনা ঘোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “জবাব না পেলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক বা রাজ্যপালের কাছে যাব।”
যারা বীজ, ট্রাক্টর নিয়ে কারবার করে তারা রাস্তা গড়বে কী করে, তদারকিরই বা কী হবে? মন্ত্রী বলেই কি আপনি প্রথা ভাঙছেন?
সরাসরি জবাব দেননি রাজীববাবু। তাঁর বক্তব্য, “আমিই পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের কাছে তদ্বির করে ওই রাস্তার টাকা বরাদ্দ করিয়েছি। টাকা বরাদ্দ করাব আমি, আর নাম কিনবে জেলা পরিষদ এটা মানব না।” তবে সুব্রতবাবু বলেছেন, “ওরা রাস্তাটা করতে চাইছে, করুক না। দেখভালের জন্য আমরাও তো আছি।” কৃষি-শিল্প নিগম ইতিমধ্যেই রাস্তার কাজ করানোর জন্য টেন্ডারও ডেকে ফেলেছে।
ডোমজুড়ের যে রাস্তা বিতর্কের কেন্দ্রে তার বিস্তারপশ্চিম নারনা থেকে ভাস্কুর বেলতলা, নারনা পঞ্চাননতলা, বলুহাটি স্কুল, বেনারস রোড পর্যন্ত। গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের (আরআইডিএফ) টাকায় জেলা পরিষদকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তা তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিল রাজ্য পঞ্চায়েত দফতরই। একই সঙ্গে জগৎবল্লভপুর এবং শ্যামপুর ব্লকেও তিনটি রাস্তা অনুমোদিত হয়। ২০১২-র শেষে পঞ্চায়েত দফতর জেলা পরিষদকে চারটি কাজের জন্যই টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু করতে বলে। বাকি তিনটি কাজের জন্য জেলা পরিষদ টেন্ডার ডাকলেও সেচমন্ত্রীর আপত্তিতে ডোমজুড়ের কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়।
প্রশাসন সূত্রের খবর, মন্ত্রীর আপত্তি জেনে পঞ্চায়েত দফতর হাওড়া জেলা প্রশাসনকে জানিয়ে দেয়, জেলা পরিষদের মাধ্যমে নয়, অন্য কোনও উপায়ে যেন এই রাস্তা নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই নির্দেশ পেয়েই সেচমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। রাস্তা তৈরির দায়িত্ব পায় কৃষি-শিল্প নিগম।
জেলা পরিষদের হাত থেকে এ ভাবে দায়িত্ব কেড়ে অন্য সরকারি সংস্থাকে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ঘিরে সমালোচনার ঝড় উঠেছে খাস পঞ্চায়েত দফতরেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্তার বক্তব্য, আরআইডিএফ তহবিল থেকে রাস্তা গড়ার যে সব প্রকল্প নেওয়া
হয়, সেগুলির প্রস্তাব পাঠানো বা বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) তৈরি করে থাকে সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদই। তাই জেলা পরিষদের হাত দিয়েই সে কাজ করানোটাই প্রথা। ওই আধিকারিকেরা বলছেন, “স্রেফ এক মন্ত্রীর আব্দার রাখতে কৃষি-শিল্প নিগমকে যে ভাবে কাজটা দেওয়া
হল, তা নজিরবিহীন।”
বাম-শাসিত হাওড়া জেলা পরিষদের কর্তারাও ক্ষোভ চেপে রাখছেন না। পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ আনন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “রাস্তাটা গড়ার প্রস্তাব আমাদের। বহু টাকা খরচ করে বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্টও আমরাই পাঠিয়েছি। সেই প্রকল্প রিপোর্টের ভিত্তিতেই কাজ হচ্ছে। অথচ অন্যায় ভাবে বাদ দেওয়া হল আমাদের।” জেলা সভাধিপতি মীনা ঘোষ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “যারা বীজ-ট্রাক্টর বেচে, তারা গড়বে রাস্তা! এ জিনিসও দেখতে হল!” তাঁর বক্তব্য, “আসলে সেচমন্ত্রী এলাকায় নাম কিনবেন বলে এমন অন্যায় দাবি করলেন। মজার ব্যাপার হল, প্রশাসন তা মেনেও নিল!
সেচমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, “আমি ডোমজুড়ের বিধায়ক হওয়ার পর থেকেই এলাকার বাসিন্দারা আমার কাছে এই রাস্তা তৈরির দাবি জানান। তাতে গুরুত্ব দিতেই হত। তা ছাড়া, নির্মাণের কাজ করার অভিজ্ঞতা কৃষি-শিল্প নিগমের আছে। প্রশাসন যোগ্য বুঝেই আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে।”
যদিও কৃষি-শিল্প নিগমের একাধিক কর্তা মেনেছেন, “আমরা ওই চাষের কাজের জন্য ছোট বাঁধ-ঠাঁধ গড়েছি। কিছু ছোট খাল সংস্কার করেছি।
রাস্তা গড়ার অভিজ্ঞতা কবে হল, মন্ত্রীই বলতে পারবেন।” |