|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
কোথায় দোল খেলছেন সুনীলদা
দিকশূন্যপুরে চলে গিয়েছেন যে মানুষটা তাঁকে ছাড়া কি উত্সব মানায়? ভাল লাগে আবিরের মৌতাত?
তাই এ বার দোলে আর শান্তিনিকেতন নয়। কলকাতায় থাকছেন স্বাতীদি। লিখছেন পারিবারিক বন্ধু সৌমিত্র মিত্র |
আজ শান্তিনিকেতনের ফুলডাঙা শুনশান। ঘন ঘন রিকশা নেই। গাড়ির শব্দ নেই। বাড়ির দরজা বন্ধ। গাছের ফুলগুলো ঝিমিয়ে পড়েছে। কোনও ব্যস্ততা নেই এই দোতলা বাড়িটায় কিংবা পাশে আমাদের বাড়িতে।
গত কুড়ি বছর দোলের আগের দিন শুরু হত উত্সব। যোগেন চৌধুরীর বাড়ির প্রশস্ত বাগানে বসন্তের গান, পানীয়, আহারে শান্তিনিকেতনে দোলের আড্ডা শুরু। মোহন সিংহের গান, সেই সঙ্গে শান্তিনিকেতনের রাজা, পম, তোতা, নীলাঞ্জন, সবার সমবেত কণ্ঠে বসন্তের রঙের ছটা ছড়িয়ে পড়ত। শেষমেশ গান ধরতেন সুনীলদা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যোগেনদার বাড়িতে এ বার সেই অনুষ্ঠানে ইতি পড়ল। নেই সুনীলদা, নেই গণেশ পাইন। ধরা গলায় যোগেনদা বললেন।
দোলের দিন সকালে গাড়িতে কলাভবনের প্রাঙ্গণে। সুনীলদা, স্বাতীদির সঙ্গে আমরা সকলে। চেনা-অচেনা মানুষের ভিড়ে আবির মেখে সুনীলদা উপভোগ করছেন দোলের সুবাতাস। পলাশ ফুলের মালা গেঁথে ছোট ছোট মেয়েরা তাঁকে ঘিরে গান গাইছে। সুনীলদার ক্লান্তি নেইসেখানেও একের পর এক গান আর নাচ। মুহূর্তের জন্যও বিরক্তির ছাপ পড়ে না সুনীলদার চোখে মুখে।
চলো এবার সুবর্ণরেখায় যাই। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সৌজন্যে গরম সিঙাড়া ও জিলিপি। তখনও সুনীলদাকে ঘিরে নানা মানুষের ভিড়। সুনীলদাও ভালবেসে আবিরের টিপ পরিয়ে দিচ্ছেন।
এবার ফুলডাঙা। বন্ধু, আত্মীয় সমাগমের ভিড়ে উথলে উঠছে ‘একা এবং কয়েক জন’।
উচ্ছ্বাস ও ঔজ্জ্বল্যে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উত্সব এক অন্য চেহারায়। বাড়ির পুকুরে জাল পড়েছে। টাটকা মাছ উঠবে। মাছ ভাজা দিয়ে আপ্যায়িত হবে বাড়ির পরিজনেরা। |
দোলের সময় শান্তিনিকেতনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
এই স্মৃতিগুলো থাক। সুনীলদা নেই। স্বাতীদি বললেন, এ বার আর শান্তিনিকেতন নয়। আমরা কলকাতায় বসে সেই ভাললাগা স্মৃতির মধ্যে ডুব দিই। ঠিক এক মাস আগে সুনীলদার বাড়ির বারান্দায় আমি, স্বাতীদি, মুনমুন। স্বাতীদি বললেন, “এবার দোলে এ বাড়ির দরজা খুলব না। কাউকে থাকতে বলব না। যে বাড়িটা আবিরে, রঙে, গানে, পলাশ ফুলের মালায় ভরে থাকত, এ বছর সব তালাবন্ধ থাকুক।”
শান্তিনিকেতনের দোলে আঠারো বছর আগে শক্তিদা (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) সপরিবারে ছিলেন। তখন শক্তিদা, সুনীলদা শান্তিনিকেতনে অতিথি অধ্যাপক। শক্তি-সুনীল নেচে নেচে আবির মেখে গান গাইছেন, যেন ফিরে এসেছে সেই পুরনো যৌবনের দিনগুলো। আহা, সেই শক্তিদাও দোলের ঠিক পরে শান্তিনিকেতনে প্রয়াত।
এই স্মৃতি সুনীলদাকে মাঝেমাঝেই আপ্লুত করত। বর্ষা আর বসন্ত ছিল সুনীলদার প্রিয় ঋতু। বাড়ির সামনে একটা নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে গান গেয়ে মাত করে দিতেন দোল উত্সবে। তাঁর গীতবিতানের প্রয়োজন নেই। সবই তো মুখস্থ।
সন্ধেবেলা কী বাহার চাঁদের। উছলে পড়ছে গাছের ওপর, পাতার ওপর। একটু আগে অর্ঘ্য যেন গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে দলবল নিয়ে, ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ শুনিয়ে গিয়েছেন।
এ বছর সেই হাসি ম্লান হয়ে গিয়েছে। দিকশূন্যপুরে চলে গিয়েছে যে মানুষটা তাঁকে ছাড়া কি উত্সব মানায়? ভাল লাগে আবিরের মৌতাত?
তার চেয়ে কলকাতার বাড়িতে বসে থাকি। রাতে সবাই মিলে খোয়াইয়ের পারে জ্যোত্স্না দেখতে যাব না! স্বাতীদি বললেন, “আমার বেশ মজা লাগত সুনীল আবির মেখে ভূত হয়ে বসে থাকত। মুখে দুষ্টুমি মাখানো হাসি, আর গোল হয়ে বসে সে কী উদ্দাম উল্লাস! এ বার আমি কলকাতায় ‘পারিজাত’এ থাকবরঙের ছটা থেকে দূরে, একা।”
তবু কেউ কেউ তো আছেই, যাঁরা সুনীলদার কথা মনে করে পাতার গায়ে একটু আবির ছড়িয়ে দেবেন...কেউ হয়তো শান্তিনিকেতনে দূরে আলপথে একলা গান গাইবে‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই...’
আবার আমার মতো কেউ ‘গীতবিতান’ এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাত্ মনে করবে সুনীলদার সেই কবিতা হাহাকার মেশা উচ্চারণে/ কে বলে আপন মনে/ আমি পরিত্রাণ ভালবাসি।
দূর সুনীলদা, কি সব পাগলামি করে চলে গেলেন। |
|
|
|
|
|