রক্ত-হোলির স্মৃতি নিয়ে ত্রাসের প্রহর গোনে দাম-বাড়ি
দোলমঞ্চে ভাঙা মূর্তিগুলো পড়েই রয়েছে। এ বছরে তাতে আর রঙের প্রলেপ পড়েনি। পড়বেও না।
প্রতি বার দোলের আগে বিশরপাড়ার যে দাম-বাড়ি উৎসবের উদ্দীপনায় ভাসত, এ বার তা চাপা পড়েছে আতঙ্কের কালো চাদরে। গত দোলের সেই বিভীষিকা-কাণ্ডের পর থেকে এই এক বছরে নয় নয় করে ৫৭টি হুমকি পেয়েছে দাম-পরিবার! এক বছর আগের কালান্তক দিনটার এক-একটা মুহূর্ত অগোচরে মনের পর্দায় ভেসে উঠলে এখনও শিউরে ওঠেন অশীতিপর রেণুবালা দাম।
অসীম দাম
রেণুবালাদেবী অসীম দামের মা। কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল সেই অসীম দাম, মদ্যপ দুষ্কৃতীদলের তাণ্ডব ঠেকাতে গিয়ে গত দোলের দিন যিনি বেঘোরে খুন হয়ে গিয়েছেন নিজের বাড়ির সামনে। এবং এই এক বছরে যাঁর পরিবার বিচার তো দূর, সরকারি তরফে সাহায্যের মৌখিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া কিছু পায়নি বলে অভিযোগ। বরং দমচাপা ত্রাসের মধ্যে দিয়ে কাটছে ওঁদের প্রতিটা দিন কখন আবার চড়াও হয় দুর্বৃত্তের দল, কখন বাড়ির দরজায় এসে ফেটে পড়ে বোমার পর বোমা। কী হয়েছিল আগের দোলে?
গত বছরের ৮ মার্চ ছিল দোলপূর্ণিমা। উত্তর ২৪ পরগনার বিশরপাড়ায় নবজীবন কলোনিতে দাম-বাড়িতে প্রতি বারের মতো দোলপুজোর আয়োজন হয়েছিল। ভরদুপুরে হঠাৎ বাড়িতে ঢুকে পড়ে জনা আটেক মদ্যপ যুবক। অভিযোগ, রং মাখানোর ছলে বাড়ির মহিলাদের হেনস্থার চেষ্টা করে তারা। অসীমবাবু বাধা দিলে ছেলেগুলো তখনকার মতো চলে যায় বটে, কিন্তু কিছু ক্ষণ পরে ফিরে আসে দলে ভারী হয়ে। হকি স্টিক, ভোজালি নিয়ে অসীমবাবুর উপরে চড়াও হয়। তিনি গুরুতর জখম হন। তাঁর ভাগ্নির শ্লীলতাহানিও করা হয় বলে অভিযোগ।
হামলায় বাড়ির আঠারো জন মহিলা আহত হয়েছিলেন। অসীমবাবুর বাড়ির লোক নিমতা থানায় গিয়েছিলেন ডায়েরি করতে। ঘটনাস্থল তাদের এলাকায় নয় বলে নিমতার পুলিশ দায় এড়ায়। এয়ারপোর্ট থানাও প্রথমে তা-ই করেছিল, পরে চাপে পড়ে অভিযোগ নেয়।
ঘটনার তিন দিন পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় অসীমবাবুর। সপ্তাহ পেরোতে সিআইডি তদন্তের দায়িত্ব নেয়, ধরা পড়ে মূল অভিযুক্ত পঙ্কা দত্ত-সহ পাঁচ জন। যদিও কোর্টে কাগজপত্রের গণ্ডগোলে পঙ্কা জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। পরে আদালত ভুল শুধরে জামিন নাকচ করলেও পঙ্কা ততক্ষণে চম্পট দিয়েছে, আজও সে ফেরার। অভিযুক্ত-তালিকার আরও তিন জন ধরা পড়েনি। ইতিমধ্যে মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিআইডি-র স্পেশ্যাল আইজি বিনীত গোয়েল। পুলিশ-সূত্রের খবর: আগামী মাসে চার্জ গঠন করা হবে। অসীমবাবুর বাড়ির লোক অবশ্য বলছেন, পুলিশ নাগাল না-পেলে কী হবে, অসীম-হত্যায় কিছু অভিযুক্ত পাড়ায় দিব্যি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মামলা তোলার জন্য তাঁদের হুমকি, টোপও দিচ্ছে।
এবং এই কারণেই আতঙ্ক এখনও পিছু ছাড়েনি দাম পরিবারের। হাইকোর্ট নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বললেও তাঁরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। “ঘটনার পর থেকে ৫৭টি হুমকির অভিযোগ দায়ের করেছি। যাতে কেউ সাক্ষ্য দিতে যেতে না-পারি, সে জন্য মাঝরাতে বাড়িতে বোমা পড়েছে, গুলি চলেছে। কখনও ভাঙচুর হয়েছে। নিরাপত্তা কোথায়?” বলছেন অসীমবাবুর ভাই শেখর দাম। তাঁর প্রশ্ন, “পুলিশ বলছে, বাইরে বেরোবেন না। অথচ কোর্টে হাজিরা তো দিতে হবে? রাস্তায় হামলা হলে কে বাঁচাবে?” সম্প্রতি তাঁরা ঘটনার সিবিআই-তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। ক’দিন বাদে তার শুনানি।
পাশাপাশি সরকারের ‘শুকনো প্রতিশ্রুতি’ নিয়েও ক্ষুব্ধ অসীমবাবুর পরিজনেরা। তাঁদের আক্ষেপ, ঘটনার পরে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ওঁদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের এক জনকে চাকরি ও আর্থিক সাহায্যের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তা প্রতিশ্রুতিতেই আটকে রয়েছে। অসীমবাবুর ভাগ্নি মামন ধরের কথায়, “মামাই ছিলেন বাড়ির একমাত্র রোজগেরে। আমরা এখন জলে পড়ে গিয়েছি।” তাঁর এ-ও প্রশ্ন, গার্ডেনরিচে নিহত পুলিশকর্মী তাপস চৌধুরীর মেয়ে যদি চাকরি পেতে পারেন, তা হলে ওঁরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন কেন? সরকারের কী বক্তব্য?
মদনবাবুর দাবি, দাম-পরিবারের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। যা শুনে মামনের পাল্টা অভিযোগ, তাঁরা পনেরো বার মহাকরণে ও সাত বার কালীঘাটে দরবার করেছেন, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বা পরিবহণমন্ত্রী কারও দেখা পাননি। এমনকী, চিঠিরও উত্তর মেলেনি। স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও তাঁদের পাশে দাঁড়াননি বলে পরিবারের দাবি।
এই নিরন্তর আতঙ্ক আর না-পাওয়ার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দিন কাটছে দাম-পরিবারের। বন্ধ হয়ে গিয়েছে বাড়ির বাষট্টি বছরের পুরনো দোল উৎসব। যত বার ফাঁকা দোলমঞ্চ আর ভাঙা মূর্তিগুলো চোখে পড়ে, তত বার বছর-পুরনো দগদগে স্মৃতির আঘাতে কেঁপে ওঠেন রেণুবালা। সে দিন তাঁকেও রেয়াত করেনি মদ্যপেরা। কুপিয়েছিল ছোরা দিয়ে। সে ক্ষত শুকোলেও মানসিক আঘাতে তিনি এখন শয্যাশায়ী। এক রাশ শূন্য দৃষ্টি মেলে বৃদ্ধা বিড়বিড় করে বলেন, “পুজো চলার সময়েই ছেলেটাকে মেরে ফেলল! ঠাকুরের মূর্তিগুলো ভেঙে দিল। কেউ পাশে দাঁড়াল না! দোলমঞ্চ ও ভাবেই পড়ে থাক। আর ওখানে যাব না।”
এ বার দোলে দাম-বাড়ি তাই নিস্তব্ধ। কীর্তনের আসর বসবে না, পাত পড়বে না খিচুড়ি ভোগের। শুধু ছবি হয়ে থাকবেন এক প্রতিবাদী পুলিশকর্মী। আর পরিজনেরা দিন গুনবেন সুবিচারের আশায়।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.