শ্লীলতাহানি বা খুনের উদ্দেশ্যে নয়, স্রেফ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’কে কড়কে দিতেই দোলের দুপুরে বিশরপাড়ায় অসীম দামের বাড়িতে দুষ্কৃতীরা চড়াও হয়েছিল বলে পুলিশ দাবি করছে।
কলকাতা পুলিশের ওই কনস্টেবল খুন হওয়ার পরে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশের বক্তব্য, অসীমবাবুর এক ভাইকে ‘শিক্ষা দিতে’ বাড়িতে ঢুকেই মত্ত যুবকের দল সামনে পেয়ে গিয়েছিল তাঁর ভাগ্নিকে। জবরদস্তি রং মাখানোর মাধ্যমে তারা মেয়েটির শ্লীলতাহানি করে। বাধা দেন অসীমবাবু। তখনই হামলাকারীরা তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে তদন্তকারীদের প্রাথমিক ধারণা।
উত্তর ২৪ পরগনার বিশরপাড়া নবজীবন কলোনির বাড়িতে বৃহস্পতিবারের ওই হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন আটচল্লিশ বছরের অসীম দাম। অভিযোগ, মদ্যপ দুষ্কৃতীরা তাঁকে হকিস্টিক দিয়ে বেধড়ক পেটায়, ধারালো অস্ত্রে কোপের পর কোপ মারে। রক্তাক্ত অসীমবাবুকে প্রথমে উত্তর দমদম পুর-হাসপাতালে নিয়ে গেলে দুর্বৃত্তেরা সেখানে গিয়েও চিকিৎসকদের শাসায় বলে অভিযোগ। তাঁকে আরজিকর এবং পরে বাইপাসের এক হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তবু শেষরক্ষা হয়নি। রবিবার সকালে অসীমবাবু মারা যান।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর: অসীমবাবুর আততায়ীরা প্রায় সকলেই এলাকার ছেলে, অধিকাংশই চোলাইয়ের কারবার ও জমির দালালিতে যুক্ত। কিন্তু অসীমবাবুর ভাইয়ের সঙ্গে তাদের টক্কর কেন? |
পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত বলছে, বিশরপাড়া-কোদালিয়া স্টেশন লাগোয়া দোকান ও একটি জমির দখল নিয়ে অসীমবাবুর ভাই শেখর দামের সঙ্গে বিবাদ চলছিল অভিজিৎ ঘোষের। অভিজিৎই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত। পুলিশের দাবি, জমিটিতে একটি বহুতল তৈরির কথা। তার মালপত্রের বরাত, ফ্ল্যাটের দাম ইত্যাদি নিয়ে সম্প্রতি দু’জনের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল। তারই জেরে অভিজিতেরা দলবল নিয়ে শেখরকে ‘শিক্ষা’ দিতে বাড়িতে ঢোকে বলে তদন্তকারী ও বাসিন্দাদের কথায় ইঙ্গিত মিলেছে। যদিও শেখরবাবু তা মানতে চাননি। সোমবার তিনি বলেন, “অনেকে এ সব রটাচ্ছে। মিথ্যে কথা।”
কিন্তু অন্য সব বাড়ি ছেড়ে দাম-বাড়িতেই কেন হামলা?
শেখরবাবুর ব্যাখ্যা, “ওরা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের বাড়িতে কীর্তন হচ্ছিল। সেই শুনেই বোধহয় ঢুকে পড়েছে।”
শেখরবাবু পেশা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে পুলিশ। এ দিন রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্রের কাছে শেখর অবশ্য বলেন, “দাদাই ছিল আমাদের সংসারে একমাত্র রোজগেরে।” মন্ত্রীর কাছে একটা কাজের দাবিও করেছেন নিহত কনস্টেবলের ভাই।
রবিবার অসীমবাবুদের বাড়িতে গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। এ দিন যান মদনবাবু। দু’জনেই দুষ্কৃতীদের অবিলম্বে ধরতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন। এবং দু’জনেরই দাবি, দুষ্কৃতীরা সিপিএমের লোক। কিন্তু দুই মন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও পুলিশ অভিযুক্ত ১১ জনের কাউকে এখনও ধরতে পারেনি। ‘সিপিএম-আশ্রিত’ দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারে এত বিলম্ব কেন?
বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (বিমানবন্দর) তরুণ হালদার এ দিন বলেন, “ধরার চেষ্টা চলছে।” এলাকাবাসীর একাংশের অবশ্য বক্তব্য, মূল অভিযুক্ত অভিজিৎ আগে সিপিএমের ‘ছত্রচ্ছায়ায়’ থাকলেও পালাবদলের পরে সে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী। এমনকী, স্টেশন চত্বর-সহ বিভিন্ন জায়গায় মুখ্যমন্ত্রীর মুখের বিশাল বিশাল ফ্লেক্স টাঙিয়ে নীচে নিজের নামও সে লিখে দিয়েছিল! যেগুলো শনিবারই রাতারাতি কে বা কারা খুলে নিয়েছে! যদিও বিশরপাড়া টাউন তৃণমূল সভাপতি সাধন ঘোষের মন্তব্য, “কে বলেছে অভিজিৎ তৃণমূল করে? ভাল করে ঘুরুন, বুঝবেন ও আসলে সিপিএমের-ই লোক।”
অভিজিতের পেশা কী?
অনুসন্ধানে জানা গেল, ওই তল্লাটে জমির দালালি, রেল ও হাসপাতালে ঠিকাদারির পাশাপাশি নিউ ব্যারাকপুরে চোলাই মদের বাজারও ‘অভিজিৎ গ্যাং’-এর কব্জায়। বছর বিয়াল্লিশের অভিজিতের দলে তৃণমূলের ছেলে যেমন রয়েছে, তেমন কংগ্রেস ও সিপিএমের ছেলেও কম নেই। বস্তুত ‘কারবারে’ তারা দলের রং দেখে না বলেই জানিয়েছে এলাকাবাসী।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত আর স্থানীয় মানুষের বয়ান অনুযায়ী, দোলের দুপুরে অভিজিৎরা প্রথমে দাম-বাড়িতে ঢুকলে শেখরবাবু তাদের সঙ্গে মারপিটে জড়িয়ে পড়ে আহত হন। আবার তাঁর বাঁশের আঘাতে জখম হয় অভিজিতের দলের এক জন। তখন তারা পিছু হটে। পরে সপ্তগ্রামে গিয়ে আরও ছেলে ডেকে ফের শেখরবাবুর বাড়িতে চড়াও হয়। পুলিশ জানাচ্ছে, তখনই শেখরবাবুর ভাগ্নির শ্লীলতাহানি করা হয়। যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের রোষের মুখে পড়েন অসীমবাবু।
বিশরপাড়া-কোদালিয়া স্টেশনের পশ্চিমে নবজীবন কলোনি। পূর্বে সপ্তগ্রামে অভিযুক্তদের বাড়ি। মঙ্গলবার দু’টো এলাকাই ছিল থমথমে। অভিযুক্তদের প্রায় প্রত্যেকের বাড়ির দরজায় তালা, অভিজিতের বাড়িতেও। যদিও পাড়ার অনেকে বলছেন, “শনিবার পর্যন্তও অভিজিৎ ও তার সঙ্গী কু্ন্তককে পাড়ায় দেখা গিয়েছে। শুধু পুলিশই তাদের দেখা পেল না!”
কুন্তক ওরফে বাবু চক্রবর্তী ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত। অভিযুক্তদের ‘সিপিএম-ঘনিষ্ঠতা’র প্রসঙ্গ উঠে আসার অন্যতম উৎসও সে। কুন্তকের জ্যাঠা স্বপন চক্রবর্তী বলেন, “আমার ভাই শ্যামল (কুন্তকের বাবা) এক সময়ে সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য ছিল। এখন দলীয় সদস্যপদ নেই। বাবুও তেমন রাজনীতি করে না। ওই দিন বাবুরা মদ খেয়েছিল। অভিজিত এসে ডাকতেই বেরিয়ে যায়।”
দিদির সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে মদ্যপ দুষ্কৃতীদের হাতে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রাজীব দাস খুন হয়েছিল গত বছর ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র রাতে। উত্তর ২৪ পরগনার সদর বারাসতের ওই ঘটনায় রাজ্য জুড়ে শোরগোল পড়ে। বছর না-ঘুরতেই একই জেলায় প্রায় একই ধরনের এই হত্যাকাণ্ড স্থানীয় মানুষের মনে আতঙ্কের সঞ্চার করেছে। এলাকার মহিলারা বলছেন, বেশ কিছু দিন ধরে বিশরপাড়া-কোদালিয়া এলাকা শান্ত ছিল। চোলাইয়ের ভাটিগুলোও ছিল বন্ধ। নজরদারির অভাবে ফের ভাটি আর ঠেক চালু হয়ে গিয়েছে। উপরন্তু বিরাটি ছাড়িয়ে প্রোমোটারি-রাজ এখানেও থাবা বসিয়েছে।
আর এই দু’য়ের জেরে সমাজবিরোধী কাজকর্মও দিন দিন বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন এলাকাবাসী। |