প্রবন্ধ...
এই সরকার কি উত্তরসূরিদের জন্য
আরও বড় ঋণের বোঝা রেখে যেতে চায়?
কী কেন্দ্র, কী রাজ্য, যে কোনও সরকারের বাজেট যখন পেশ করা হয়, তখন সাধারণত সবাই পরের বছরের আয়, ব্যয় এবং ঘাটতি নিয়ে বেশি আলোচনা করে। এগুলো হল ‘বাজেট এস্টিমেট’ অর্থাৎ বাজেটে অনুমিত হিসেব। বছরের শেষে যখন ‘রিভাইজ্ড এস্টিমেট’ বা সংশোধিত হিসেব পেশ করা হয়, তখন সচরাচর দেখা যায়, অনুমিত অঙ্ক থেকে অনেক কিছুই অনেক পালটে গিয়েছে। বাজেটের অনুমানকে তাই খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া ঠিক নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্প্রতি যে বাজেট পেশ করেছে, তার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কথাটা মনে রাখা দরকার।
ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন বলেছে, ২০১৩-১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজকোষ ঘাটতি জি এস ডি পি’র ০.৫ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে এবং পরের বছরে সেই ঘাটতিকে শূন্যে নামাতে হবে। পাশাপাশি, রাজকোষ ঘাটতিকে এই দুই বছরেই ৩ শতাংশের মধ্যে রাখা চাই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই লক্ষ্যগুলি মেনে নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন কি? তাঁর বাজেটের অঙ্ক কী বলছে, সেটা প্রথমে দেখা যাক। তার পর দেখা যাবে, সেই অঙ্ক কতটা বিশ্বাসযোগ্য।
২০১৩-১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের জি এস ডি পি কত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে? সরাসরি হিসেব মেলে না। ঘুরিয়ে একটা হিসেব কষা যায়। কেন্দ্রীয় সরকারি (সি এস ও) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১২-১৩ সালে টাকার অঙ্কে রাজ্যের জি এস ডি পি আগের বছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬,৩০,৩৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে, অর্থমন্ত্রীর হিসেব অনুসারে, প্রকৃত উৎপাদন বেড়েছে ৭.৬ শতাংশ, বাকিটা মূল্যবৃদ্ধির অবদান। যদি ধরে নেওয়া যায়, আগামী বছরেও টাকার অঙ্কে জি এস ডি পি ওই ১৬ শতাংশই বাড়বে, তা হলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে ৭,৩১,২৪৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি, অর্থমন্ত্রীর বাজেটে আগামী বছরের রাজস্ব ঘাটতি ধরা হয়েছে ৩,৪৮৮ কোটি টাকা, রাজকোষ ঘাটতি ১৩,৪১৪ কোটি টাকা। জি এস ডি পি’র যে অঙ্ক কষা হল, তার অনুপাত হিসেবে রাজস্ব ঘাটতি হবে ০.৫ শতাংশ, রাজকোষ ঘাটতি ১.৮ শতাংশ। আপাতদৃষ্টিতে, অর্থ কমিশনের শর্ত পূর্ণ হচ্ছে।
পথ কোথায়? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।
কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে, বাস্তব তার সঙ্গে মিলবে কি? এখানেই বাজেটের অনুমান আর সংশোধিত হিসেবের তুলনা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এক বছর আগে যখন পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী ২০১২-১৩ সালের বাজেট পেশ করেন, তখন তিনি অনুমান করেছিলেন, রেভিনিউ ডেফিসিট বা রাজস্ব ঘাটতি হবে গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রডাক্ট (জি এস ডি পি) বা রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (কার্যত, রাজ্যের মোট আয়ের) ১.১ শতাংশ, ফিসকাল ডেফিসিট বা রাজকোষ ঘাটতি হবে ২.৫ শতাংশ। এক বছর পরে তিনি যখন ২০১২-১৩’র সংশোধিত হিসেব পেশ করলেন, দেখা গেল, দুটি অনুপাতই অনেক বেড়ে গিয়েছে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২.১ শতাংশ, রাজকোষ ঘাটতি ৩.৩ শতাংশ। সোজা কথা হল, রাজ্য সরকারি আয়ব্যয়ের ফারাকটিকে লক্ষ্যমাত্রায় বেঁধে রাখা যায়নি। আগামী দু’বছরে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে?
প্রশ্নটা বিশেষ করে ওঠে এই কারণে যে, চলতি খাতে সরকারি ব্যয়কে লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বেঁধে রাখা খুব কঠিন হবে। এই খরচের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে বেতন, পেনশন এবং পুরনো ধারের ওপর সুদ মেটাতে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “বামফ্রন্ট দু’লক্ষ কোটি টাকার ওপর ঋণের বোঝা রেখে গিয়েছে; ৩২০০০ কোটি টাকার রাজস্ব আমাদের কোষাগারে আসছে, কিন্তু তার মধ্যে ২৫০০০ কোটি চলে যাচ্ছে দেনার দায় মেটাতে, এটাই ট্র্যাজেডি।” সত্যিই ট্র্যাজেডি। তবে এই ঋণের বোঝা জমাতে বামফ্রন্টের কত দিন লেগেছিল? ধরা যাক, দশ বছর। এ বার কিছু হিসেব দিচ্ছি। ২০১১-১২ সালে রাজ্য সরকারের মোট ঋণ ছিল ২,০৭,৭০২ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪’য় সেটা দাঁড়াবে ২,৪৭,৪২৩ কোটি। মানে, বামফ্রন্ট যদি দশ বছরে দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণ বাড়িয়ে থাকে, বতর্মান সরকার দু’বছরের মধ্যে ঋণ বাড়াচ্ছে চল্লিশ লাখ। উন্নতিটা কোথায় হল তা হলে? এর পরে যখন অন্য সরকার আসবে, তাকেও ঋণশোধের দায় সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখার দাবি জানাতে হবে। সেটা আরও বড় ট্র্যাজেডি হবে না কি? পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ঋণের অঙ্ক এখন জি এস ডি পি’র অনুপাত হিসেবে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। এক কথায়, বিপজ্জনক। এটা ঠিকই যে, চলতি খরচের অনেকটাই (বেতন, পেনশন এবং সুদ) এড়ানোর কোনও উপায় নেই। কিন্তু এই ধরনের খরচ বাড়ানোর নতুন উদ্যোগ যাতে যথাসম্ভব না করা হয়, সেটা দেখা তো সরকারের কাজ। যেমন, সরকারি কর্মীর সংখ্যা যথাসাধ্য না বাড়ানো, সরকারি কাজে যথাসম্ভব চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ, পেনশনের নানা বিকল্প ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ ইত্যাদি। এই ভাবে চেষ্টা করলে কাল না হোক পরশু ব্যয়বৃদ্ধির হার কমবে। কিন্তু তার জন্য রাজস্ব নীতির একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। তেমন কিছুই দেখছি না।
শেষে আয়ের কথা বলি। আয় বলতে চলতি খাতে আয়, কারণ মূলধনী খাতে আয় মানে তো ঋণ সেটা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা-ই দাঁড়িয়েছে। লক্ষণীয়, চলতি খাতে রাজ্যের যা আয়, তার ২৮.৬ শতাংশ হল কেন্দ্রীয় রাজস্বের ভাগ, আর ২৪.৪ শতাংশ কেন্দ্রের অনুদান। অর্থাৎ রাজ্যের নিজের আদায় মোট আয়ের অর্ধেকেরও কম।
এই পরিস্থিতির পিছনে এ দেশের কেন্দ্র-রাজ্য আর্থিক ক্ষমতা বণ্টনের বৈষম্যের একটা ভূমিকা আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও অনস্বীকার্য যে, রাজ্যের নিজের রাজস্ব আদায় এবং রাজ্য সরকারি সংস্থার আয় বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া উচিত। বিক্রয় কর এবং আবগারি শুল্ক তো জি এস টি ও ভ্যাট-এর মধ্যে ঢুকে যাবে। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য যেমন যুক্তমূল করের (ভ্যাট) ক্ষেত্রে সংশোধনের মতো কিছু উদ্যোগ করা হয়েছে, সেটা ভাল। কিন্তু রাজ্যের রাজস্ব বাড়ানোর প্রধান উপায় বলতে এখন সম্পত্তি সংক্রান্ত কর আর গাড়ির ওপর কর, এবং সরকারি পরিষেবার মাসুল বাড়ানো, সে সব ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু করা হয়নি।
এক কথায় বলা যায়, আয়ব্যয়ের কাঠামো সংস্কারের কোনও স্পষ্ট দিশা পশ্চিমবঙ্গের বাজেটে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মরুভূমিতে এখনও গাছের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.