মৃত্যুর পরে তাঁর দেহটি যেন মেডিক্যাল পড়ুয়াদের কাজে লাগে, এমনই ইচ্ছা ছিল নীলকমল মণ্ডলের। তাঁর পরিবারের লোকেরাও সেই ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। শনিবার গভীর রাতে নীলকমলবাবুর (৭২) মৃত্যু হয়। অভিযোগ, কলকাতার চারটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ঘুরেও দেহদানে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত নিমতলা শ্মশানঘাটে দেহটি দাহ করে দিতে বাধ্য হন পরিজনেরা। চার জায়গা থেকেই তাঁদের বলা হয়, “রবিবার এ সব বন্ধ থাকে। সোমবার আসুন।” দেহদান আন্দোলন যখন এ রাজ্যে সবে কিছুটা মজবুত চেহারা নিতে চলেছে, তখন এই ধরনের নজির সেই আন্দোলনকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এই ঘটনায় সেই প্রশ্ন উঠেছে।
নীলকমলবাবুর ছেলে নীলাঞ্জন মণ্ডলের অভিযোগ, আর জি কর, নীলরতন সরকার, কলকাতা মেডিক্যাল ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ— এই চার জায়গায় তাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু কোনও হাসপাতালই দেহ নিতে চায়নি। বরং “রবিবার এ সব হয় নাকি?” বলে তিরস্কারের ভঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে, যেন প্রিয়জনের দেহ দান করতে গিয়ে তাঁরা কোনও অপরাধ করছেন। নীলাঞ্জনবাবু বলেন, “আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করছিলেন। সর্বত্র এক জবাব। আর জি কর থেকে বলা হয়, ‘কোনও মর্গে রাখার ব্যবস্থা করুন। সোমবার আনবেন।’ যেন গোটা বিষয়টাই আমাদের দায়।”
নীলকমল মণ্ডল |
বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন নীলকমলবাবু। শনিবার রাতে তাঁর মৃত্যুর পরে রবিবার সকালে দেহটি নেন পরিবারের লোকেরা। অভিযোগ, তার পরে দিনভর চলতে থাকে ওই ভোগান্তি। যেহেতু রবিবার হাসপাতালে সিনিয়র চিকিৎসকরা তো বটেই, এমনকী প্রশাসনিক স্তরের কর্তাদেরও পাওয়া যায় না, তাই অভিযোগ জানানোর মতো কাউকেও তাঁরা খুঁজে পাননি। সোমবার বিষয়টি জানাজানি হতেই চার মেডিক্যাল কলেজের তরফে রুটিন মাফিক বলা হয়েছে, “এমন হওয়ার কথা নয়।” মেডিক্যালের ডেপুুটি সুপার মুক্তিসাধন মাইতি বলেন, “অভিযোগ মানতে পারছি না। অন্য কোথায় কী ঘটেছে জানি না, কিন্তু আমরা রবিবারেও দেহ নিই। যেহেতু অ্যানাটমি বিভাগ বন্ধ থাকে, সেই কারণে দেহ মর্গে রেখে পরিবারকে পরের দিন তা হস্তান্তর করতে বলা হয়।”
আর জি করের ডেপুটি সুপার সিদ্ধার্থ নিয়োগী বলেন, “রবিবার অসুবিধা হয় এটা ঠিক। তবে আমরা জানতে পারলে চেষ্টা করি, যাতে ফিরিয়ে না দিয়ে দেহ নেওয়া হয়।” অর্থাৎ সমস্যা যে রয়েছে, তা তিনি কার্যত স্বীকার করেন। নীলরতন সরকার ও ন্যাশনাল কর্তৃপক্ষের তরফেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা অসুবিধার কথাই বলা হয়েছে।
দেহদান আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে এমন একটি সংগঠনের তরফে ব্রজ রায় বলেন, “ঘটনাটি আমি জানি। খুবই দুর্ভাগ্যজনক। প্রায়ই এমন হচ্ছে। আমরা এ বার সরকারকে বলব, হয় আপনারা কোনও একটা ব্যবস্থা করুন। নচেৎ আমরা এ বার কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলব।”
সরকারি নিয়মে রবিবার তো বটেই, এমনকী অন্যান্য ছুটির দিনে দেহদানে আগ্রহী কোনও পরিবার এলে তা গ্রহণ করার কথা। এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশিকাও রয়েছে। তার পরেও এমন ঘটছে কী ভাবে? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “খোঁজ নিয়ে জানতে হবে কেন ওই হাসপাতালগুলি এমন করেছে। এটা হওয়ার কথা নয় কোনও ভাবেই।”
নীলাঞ্জনবাবুর পারিবারিক বন্ধু নীলাঞ্জন দত্ত বলেন, “১৯৯৫ সালে আমার মা এমনই একটা রবিবারে মারা যান। তখনও আমি বহু চেষ্টা করেও কোনও হাসপাতালে মায়ের দেহ দান করতে পারিনি। এতগুলো বছরে পরিস্থিতি যে এতটুকুও বদলায়নি, তা আবার প্রমাণ হয়ে গেল।” |