পাল্টা চিঠি, আজ দরবার রাজভবনে
রাজ্যের প্রস্তাব খারিজ মীরার
ঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে পুরোদস্তুর বক্সিং রিংয়ে ঢুকে পড়ল রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য সরকার। শুক্রবার একতরফা ভোটের দিন ঘোষণা করে তার প্রস্তাবনা করেছিল রাজ্য। সোমবার পরবর্তী রাউন্ডে নেমে রাজ্যের সেই প্রস্তাব পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠিয়ে দিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। ফলে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে অভূতপূর্ব অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে বলে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মত। এই সঙ্কট মেটাতে এ বারে হয় রাজ্যপালকে হস্তক্ষেপ করতে হবে, নয়তো ফয়সালা হবে আদালতে। পরিস্থিতি জানাতে মঙ্গলবার রাজ্যপালের কাছে যাচ্ছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। এ দিন কতটা জোরালো জবাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশন?
তারা রাজ্য সরকারকে পাল্টা যে চিঠি লিখেছে, সেখানে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে রাজ্যের বিজ্ঞপ্তিকে অবাস্তব অ্যাখ্যা দিয়ে, তা কোনও মতেই মানা সম্ভব হবে না বলে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে তারা রাজ্যকে জানিয়ে দিয়েছে, তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘণ্ট তৈরি করতে হবে।
অফিস যাওয়ার সময় রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে। ছবি: সুমন বল্লভ।
নির্ঘণ্ট নিয়ে কমিশনের মত কী? চিঠি থেকে স্পষ্ট, তারা তাদের পুরনো অবস্থানেই অনড়। অর্থাৎ, ভোট করাতে হবে তিন দফাতেই। এবং আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে প্রতি বুথে অন্তত দু’জন করে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করতে হবে। রাজ্য তাদের বিজ্ঞপ্তিতে প্রতি বুথে সশস্ত্র পুলিশ নিয়োগের কথা বলেছিল। এত সংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ কোথা থেকে পাওয়া যাবে, তার কোনও ব্যাখ্যা যে রাজ্য সরকার দেয়নি, তার-ও উল্লেখ করা হয়েছে কমিশনের এ দিনের চিঠিতে।
মুষ্টিযুদ্ধের পরের রাউন্ড রাজ্যের কোর্টে। তারা কি কমিশনের ওই দুই সুপারিশ মেনে নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু হটবে? পঞ্চায়েত দফতরের আমলাদের কথা থেকেই এ দিন পরিষ্কার, কমিশনের পাল্টা বক্তব্য তারা মানবে না। নিজেদের অবস্থান থেকে এক চুলও সরা হবে না বলে মহাকরণ থেকে ইঙ্গিত মিলেছে। তবে কমিশনের আশা, রাজ্য সরকার তাদের চিঠির জবাব দেবে। কমিশনের একটি সূত্র জানাচ্ছেন, ওই জবাবের জন্য তারা অপেক্ষা করবে। কারণ, চিঠির জবাব দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে কোনও সময়সীমা দেয়নি তারা। তবে রাজ্য সরকার সূত্রে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবারই তারা এর জবাব দেবে।

লড়াই লড়াই
• শুক্রবার রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচন আইন (২০০৩)-এর ৪২ ধারা অনুযায়ী পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা সরকারের
• সোমবার পঞ্চায়েত আইনেরই ৪৩ (২) ধারা অনুযায়ী পাল্টা চিঠি দিয়ে রাজ্যকে তাদের প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করতে বলল রাজ্য নির্বাচন কমিশন।
কমিশনের পত্রাঘাত রাজ্যের মত
• রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি অবাস্তব
• ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কমিশন একমত নয়
• তিন দফাতেই নির্বাচন করতে হবে
• কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই নির্বাচন করতে হবে
• কমিশনের বক্তব্য তারা মানছে না।
৪৩ (২) ধারা
• কমিশন যদি মনে করে রাজ্যের ঠিক করা দিনে ভোট করা সম্ভব নয়, তা তারা রাজ্যকে জানাতে পারে।
• কেন তাদের আপত্তি, তা যুক্তি দিয়ে রাজ্যকে জানাতে হবে।
• কমিশনের মত গ্রহণযোগ্য মনে হলে রাজ্য নিজেদের বিজ্ঞপ্তি বাতিল করতে পারে।
(যদি নির্বাচন কমিশনের মত রাজ্য না মানে, তা হলে কী হবে, তা এই আইনে স্পষ্ট করে বলা নেই)
এর পর কী তাতেও জট না খুললে
• রাজ্যপালের কাছে কমিশন।
রাজ্য যাতে কমিশনকে সাহায্য করে,
সে জন্য রাজ্যপাল নির্দেশ
দিতে পারেন রাজ্যকে।
• নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগে কমিশন
সরাসরি আদালতে যেতে পারে
• কমিশনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ
তুলে রাজ্যও যেতে পারে আদালতে
 

জবাবে কী বলতে পারে রাজ্য? সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ কমিশনের চিঠি জেশপ ভবনে পঞ্চায়েত দফতরে পৌঁছয়। বস্তুত, পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় সকাল থেকেই চিঠির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তা হাতে পেয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখানোর জন্য বেরিয়ে যান। যাওয়ার আগে বলেন, “আমাদের প্রস্তাব কমিশন মানেনি। একই কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই যা করার করা হবে।” তবে পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব এলে তা যে পত্রপাঠ খারিজ করে দেওয়া হবে, সেটা চিঠি হাতে পাওয়ার আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন সুব্রতবাবু। বলেছিলেন, “এমন কিছু হলে আমরাও জানিয়ে দেব, পুনর্বিবেচনা করছি না। সরকার আইন মোতাবেক কাজ করেছে। কমিশন মনে করে, তাদের সঙ্গে আলোচনার অর্থ হচ্ছে ওদের কথা মেনে নেওয়া। কিন্তু এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কমিশনের সঙ্গে সহমত না হলেও ভোটের দিন রাজ্য ঘোষণা করতে পারে।” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও মনে করেন, দিন ঘোষণা করে সরকার ভুল কিছু করেনি। তবে এই চিঠি পাল্টা চিঠিতে সংঘাতের কিছু দেখছেন না তিনি। মুকুলবাবুর বক্তব্য, “৪২ ধারায় রাজ্য সরকার যে চিঠি দিয়েছে, তা তাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আবার ৪৩ (২) ধারায় কমিশন যে চিঠি দিয়েছে, সেটাও তাদের অধিকারে পড়ে। এর মধ্যে সংঘাতের কী আছে?”
এ দিন সন্ধ্যায় মহাকরণ থেকে বেরোনোর সময়, মমতাকেও এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বিষয়টি সুব্রতদা দেখছেন। যা বলার সুব্রতদা বলবেন।”
এখন প্রশ্ন, রাজ্য কমিশনের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে?
কমিশনের সূত্রটি জানাচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে সংবিধানের ‘২৪৩ কে’ ধারায় তাঁরা রাজ্যপালের মধ্যস্থতা চাইবেন। বা সরাসরি আদালতেও যেতে পারেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মীরা পাণ্ডে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে পুরো বিষয়টি জানিয়ে রাখতে চাইছেন। সে জন্যই তিনি মঙ্গলবার রাজ্যপালের কাছে সময় চেয়েছেন।
রাজ্যপালের কাছে গেলে কী হতে পারে?
কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, রাজ্যপাল রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়ে বলতে পারেন, সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট করাতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। তবে কমিশনের এই ব্যাখ্যাও মানতে চাননি পঞ্চায়েতমন্ত্রী। তাঁর ব্যাখ্যা, “সংবিধানে রাজ্যপালের ক্ষমতা বলে যা লেখা আছে, তার অর্থ আসলে রাজ্য সরকার। যে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে, তা-ও তো রাজ্যপালের নামে। সুতরাং রাজ্যপাল আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। কিন্তু কোনও নির্দেশ দিতে পারেন না।”
রাজ্যপালের কাছে গিয়েও সঙ্কট না মিটলে আরও একটি সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছে না পঞ্চায়েত দফতর। দফতরের আমলাদের একাংশের আশঙ্কা, তাদের মত মানা হয়নি রাজ্যের মত জানার পরে এই যুক্তিতে কমিশন ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি না করে চুপচাপ বসে থাকতে পারে। এই নিয়ে আইনে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তা হলে পঞ্চায়েত ভোটের প্রক্রিয়াটাই ঝুলে যাবে। তখন রাজ্য সরকার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে আদালতে যেতে পারে।
কমিশনের এ দিনের চিঠিতে আর কী বলা হয়েছে?
রাজ্যের পঞ্চায়েত সচিবকে লেখা চিঠিতে কমিশনের সচিব তাপস রায় জানিয়েছেন, ২০০৩-এর রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করবে। ৪৩(১) ধারায় কমিশনকে নির্বাচনের পরবর্তী দফাগুলি জানিয়ে নির্ঘণ্ট প্রকাশের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা-ও চিঠিতে উল্লেখ করেছে কমিশন। ৪৩(২) ধারা উল্লেখ করে কমিশন জানিয়েছে, রাজ্য সরকারের ঘোষণা করা দিনে নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে মনে করলে সে কথা কমিশন রাজ্যকে জানাতেই পারে। কমিশন এ দিন তাই করেছে।
নিজেদের অধিকারের কথা মনে করিয়ে দিতে চিঠিতে সংবিধানের বিভিন্ন ধারারও উল্লেখ করেছে কমিশন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ার নিয়ে যে সমস্ত মামলা হয়েছে, সেগুলিরও উল্লেখ করা হয়েছে ওই চিঠিতে। কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই সব মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনের পক্ষেই রায় দিয়েছে। একই সঙ্গে চিঠিতে রাজ্যের সিদ্ধান্তকে কাঠগড়ায় তুলে কমিশন জানিয়েছে, যে ভাবে পঞ্চায়েত ভোট দু’পর্বে ভাগ করা হয়েছে, তা অবাস্তব এবং অযৌক্তিক। তারা আরও জানিয়েছে, কমিশনের একমাত্র লক্ষ্য অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। সে জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা অন্যতম কাজ। বিভিন্ন জেলা থেকে যে রিপোর্ট এসেছে এবং অতীতে ভোটের সময় হিংসার যা ইতিহাস রয়েছে, তা বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত নির্ঘণ্ট হওয়া উচিত। সে জন্য তিন দফা ভোট করাটাই যুক্তিযুক্ত। আর সে জন্য পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রয়োজন। তাই পঞ্চায়েত দফতরকে কমিশন অনুরোধ করে বলেছে, শান্তিপূর্ণ ভোটের স্বার্থেই কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া উচিত সরকারের। কমিশনের সচিব তাপস রায় বলেন, “আমরা যে বিষয়গুলি নিয়ে পরামর্শ দিয়েছি, আশা করব সেই অনুযায়ী রাজ্য ব্যবস্থা নেবে। সরকারের সিদ্ধান্ত জেনেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
চিঠি পেয়ে পঞ্চায়েত দফতরের অনেক কর্তা বলেছেন, কমিশন কার্যত হলফনামা পাঠিয়েছে। তাতে নিজেদের সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
মুষ্টিযুদ্ধের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “কমিশন আইনগত অধিকারবলেই রাজ্যকে চিঠি পাঠিয়েছে যাতে, তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে। আশা করি, সহমতের ভিত্তিতে ঠিক সময়েই পঞ্চায়েত ভোট হবে।” নিজেদের সময়ের কথা তুলে সূর্যবাবুর বক্তব্য, “আমাদের সময়ে আমরা কখনও এ রকম বিবাদে গিয়ে একতরফা ভাবে নির্বাচন ঘোষণা করিনি। আমরা কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইতাম। না পেলে অন্য রাজ্য থেকে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আসতাম।” তবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, বিবাদ মিটে গিয়ে যথাসময়ে ভোট হবে।
সেটা এখন নির্ভর করছে দু’পক্ষের উপরে। বাকিটা বলবে সময়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.