গণতন্ত্রের খেরোর খাতায় এই প্রথম বার সরকারি ভাবে পাকিস্তানের নাম উঠিল। প্রথম বার গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত জাতীয় সরকার পাঁচ বৎসরের সম্পূর্ণ মেয়াদ টিঁকিয়া থাকিতে সক্ষম হইল। ১৬ মার্চ ২০০৮ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সরকার নির্বাচনে জিতিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছিল। বহুবিধ হতাশাময় ভবিষ্যদ্বাণী সত্ত্বেও, বহু উত্থান-পতন, সংকট-বিপদ সত্ত্বেও এই মধ্য-মার্চে তাহার মেয়াদ পূর্ণ হইল। সে দেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সম্ভবত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। অঘটন না ঘটিলে এই প্রথম বার পাকিস্তানে এক নির্বাচিত সরকার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে চলিয়াছে। ইহা এক বিপুল সুসংবাদ। যত বিপন্ন, দুর্নীতিগ্রস্ত, অপদার্থ হউক, এই সরকার যে শেষ পর্যন্ত দাঁতে দাঁত দিয়া লড়িয়াছে, তাহা সাধুবাদের যোগ্য। এই কৃতিত্ব প্রধানত শাসক দল পিপিপি-রই। সমালোচনার সময় তো পড়িয়াই রহিল। কিন্তু এই অবকাশে প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির দলকে এক বার অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ জানানো কর্তব্য।
অভিনন্দন আরও জরুরি এই জন্য যে সদ্য-সফল পাকিস্তানি সরকারের সামনে কেবল বাহিরের আঘাতই ছিল না, সাংবিধানিক ব্যবস্থার অভ্যন্তর হইতেও উঠিয়া আসিতেছিল একের পর এক চ্যালেঞ্জ। গত পাঁচ বৎসর ধরিয়া পাকিস্তানে যেমন লাগাতার সন্ত্রাস হাঙ্গামা চলিয়াছে, তেমনই আসিয়াছে বিচারবিভাগের পক্ষ হইতে সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রবল আঘাত। মধ্যপথে প্রধানমন্ত্রী বদল হইয়াছে। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ক্রমাগত হুমকি শোনা গিয়াছে। রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি ও অপশাসনের কোনও অভিযোগই অসার বা অসঙ্গত নহে, কিন্তু প্রতি বারই প্রেসিডেন্ট-সহ শাসনবিভাগের শীর্ষকর্তাদের সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতিকার আলি চৌধুরি ও অন্যান্য বিচারপতির মুখে যে তীব্র অনাস্থা শোনা গিয়াছে, তাহাতে আশঙ্কা জন্মিয়াছে যে, গোটা প্রশাসন মুখ থুবড়াইয়া পড়িল বলিয়া, এবং তৎক্ষণাৎ বৃক্ষচ্যুত পক্ব আম্রের মতো দেশের শাসনভার রাওয়ালপিন্ডির সামরিক হেডকোয়ার্টার্স কুক্ষিগত করিল বলিয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহা ঘটে নাই। ব্যক্তিগত স্তরে রাজনীতিকরা ন্যায়বিচারকে কাঁচকলা দেখাইলেন ঠিকই, কিন্তু সমষ্টিগত স্তরে একটি বিরাট উপকার হইল। সরকার পড়িল না, জারদারির গগনচুম্বী দুর্নীতির যোগ্য শাস্তি হইল না, পিপিপি-র নেতৃ-মন্ত্রীদেরও পার্থিব সংগ্রহের হিসাবনিকাশ হইল না, কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের হাত হইতে গণতান্ত্রিক সরকার বাঁচিল, বিচারবিভাগকেও একচ্ছত্র আধিপত্য বিছাইতে না দিয়া শাসনবিভাগ তাহার নিজস্ব বৃত্তটি ধরিয়া রাখিল, প্রশাসনের ক্ষমতা বর্ধিত হইল, প্রধানমন্ত্রী পদটির অর্থহীনতা কমিল, প্রাদেশিক স্তরের শাসনকর্তারা অধিকতর ক্ষমতায় অন্বিত হইলেন। অর্থাৎ মোট হিসাবে ন্যায়ের জয় না হউক, গণতন্ত্রের জয় হইল।
সাধুবাদের কিয়দংশ অবশ্যই পাইবেন আর এক প্রচ্ছন্ন চরিত্র, যাঁহার নাম জেনারেল কায়ানি। নিজে যেহেতু প্রচ্ছন্ন, এবং তাঁহার কার্যকলাপও অপ্রকাশ্য, তাই এই ‘কিয়দংশ’ ঠিক কতখানি স্পষ্ট নহে। কিন্তু আন্দাজ বলে: পাক প্রশাসন পাঁচ বৎসরে এত বার তলানিতে যাওয়া সত্ত্বেও সামরিক বিভাগ যে ক্ষমতা হস্তগত না করিবারই সিদ্ধান্ত লইল, তাহা কোনও অন্যমনস্কতা নহে, বরং সুচিন্তিত নীতি। এক দিকে জঙ্গি আক্রমণের ভয়াবহতা, অন্য দিকে আফগান যুদ্ধের পরিণামে জনজাতি-বিশৃঙ্খলা রুখিতে পাক সামরিক বাহিনীর যে মনঃসংযোগ প্রয়োজন, তাহার উপর দেশ-শাসনের গুরু দায়িত্ব যুক্ত করিতে নিশ্চয়ই চাহেন নাই জেনারেল কায়ানি। ইসলামাবাদের শাসনকর্তাদের ক্রমাগত প্রভাবান্বিত ও চালিত করিতেও চাহেন নাই। এই দূরদৃষ্টি পাকিস্তানের শিশু-গণতন্ত্রকে একটি বড় ধাপ পার করাইয়া দিল। পরবর্তী ধাপগুলি অতিক্রম করা হয়তো তুলনায় সহজ হইবে। ভারতের পক্ষে ইহা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সহিত পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতির প্রথম ও প্রধান ধাপ, সে দেশের সফল গণতন্ত্র। একমাত্র গণতন্ত্রই পারে, পাকিস্তানি সমাজের সত্যকারের শোষণ-বঞ্চনার বিষয়গুলি সম্মুখে আনিয়া দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিকদের ভারত-বিরোধিতার ফাঁকা বুলিসমূহ উড়াইয়া দিতে। |