রং নয়, অপরাধ দেখুন, পুলিশকে বার্তা সিপি’র
পুলিশের কাজে শাসকদলের অন্যায্য হস্তক্ষেপের অভিযোগ যখন বার বার উঠছে, সেই সময়ে খোদ কলকাতার পুলিশ কমিশনার তাঁর বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিলেন। বাহিনীর উদ্দেশে সিপি-র স্পষ্ট বার্তা: নেতা-মন্ত্রীদের নাম করে কেউ পুলিশের কাজে অন্যায় প্রভাব খাটাতে এলে তাঁকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই, পুলিশের যা কাজ, সেটাই করে যেতে হবে।
পুলিশ সূত্রের খবর: সোমবার লালবাজারে ক্রাইম কনফারেন্সে নতুন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ এই বার্তা দিয়েছেন। সহকর্মীদের তিনি বলেছেন, ‘মাথা উঁচু করে পুলিশের চাকরি করুন। অন্যায় কোনও কাজ করবেন না, অন্যায়কে প্রশ্রয়ও দেবেন না।’ গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে পুলিশের মনোবল যখন জোরালো ধাক্কা খেয়েছে, মাঠপুকুর কাণ্ড ঘিরেও যখন পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে, ঠিক তখনই বাহিনীর উদ্দেশে সিপি’র বার্তা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে পুলিশ মহলের একাংশ। তাদের মতে, প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে সঙ্কেত পেয়েই সিপির এই মন্তব্য। পুলিশের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয়টিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার অবশেষে রাশ টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুরজিৎবাবুর কথায় এমন ইঙ্গিতও পাচ্ছেন কেউ কেউ।
প্রতি মাসে এক বার হওয়া ক্রাইম কনফারেন্সে এ দিনও উপস্থিত ছিলেন লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা। গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ অফিসার এবং বিভিন্ন ডিভিশনের ডেপুটি ও সহকারী কমিশনারদের পাশাপাশি সব থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারেরাও ছিলেন। বাহিনীর একাংশের বক্তব্য, আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে সিপি চাঞ্চল্যকর কিছু বলেননি। তিনি তাঁর বাহিনীকে পুলিশি কর্তব্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে ক্রাইম কনফারেন্সের মতো জায়গায় এ কথা বলার মধ্যেই চমকটা লুকিয়ে আছে বলে পুলিশ-কর্তাদের একাংশ মনে করছেন। তাঁদের মতে, সিপি’র মন্তব্যেই পরিষ্কার যে, বেশ কিছু কাল যাবৎ শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের নাম করে কলকাতা পুলিশের কাজে অন্যায় প্রভাব খাটানো হচ্ছিল।
এবং এরই প্রেক্ষিতে লালবাজারের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, সমালোচনার মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কি শেষ পর্যন্ত পুলিশের কাজে শাসকদলের হস্তক্ষেপে অন্তত রাশ টানতে উদ্যোগী হল?
বাহিনীর এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “সম্প্রতি বিভিন্ন ঘটনায় কলকাতা পুলিশের মুখ পুড়েছে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ কমিশনার বাহিনীকে কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে ঠিক পথে চালনা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে ভাষায় তিনি ক্রাইম কনফারেন্সে বক্তব্য পেশ করেছেন, মহাকরণের একেবারে শীর্ষ স্তরের অনুমোদন না-থাকলে সে ভাবে বলা মুশকিল।”
এ প্রসঙ্গে পচনন্দা-পর্বকেও টেনে এনেছেন ওই কর্তা। গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে ‘আনুগত্যজনিত’ জড়তা ঝেড়ে নেতা হতে গিয়ে রঞ্জিতকুমার পচনন্দাকে সিপি’র পদ খোয়াতে হয়েছে। তাঁর জায়গায় আনা হয়েছে সুরজিৎবাবুকে। “সুরজিৎবাবু সিপি হওয়ার পর ৩৯ দিন কেটেছে মাত্র। এত তাড়াতাড়ি সরকারের বিরুদ্ধে নিজের স্বাধীন মত ব্যক্ত করবেন, এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক।” মন্তব্য করেন তিনি। উল্লেখ্য, কমিশনার হওয়ার পর এ দিন ছিল সুরজিৎবাবুর দ্বিতীয় ক্রাইম কনফারেন্স। নতুন সিপি সেখানেই স্পষ্ট করে দেন, বাহিনীর কাছ থেকে তিনি কী চান। লালবাজারের খবর: সুরজিৎবাবু বলেন, তাঁর নাম করে কেউ পুলিশের কাজে অন্যায় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করলেও সেই ব্যক্তিকে অবজ্ঞা করতে হবে। পুলিশকে চলতে হবে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিয়ে।
সিপি’র মন্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতও অবশ্য হাতের কাছে মজুত। গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে পুলিশ অফিসার খুনের অভিযোগ উঠেছে খোদ তৃণমূল বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার বিরুদ্ধে। তার পরে পরেই ধাপার মাঠপুকুর-কাণ্ডে দলীয় নেতাকে খুনের ঘটনায় মামলা রুজু হয়েছে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও-র বিরুদ্ধে। আর দু’টি ঘটনায় মূল অভিযোগ একই শাসকদলের একাংশের প্রভাবে পুলিশ নিজের কর্তব্যে গাফিলতি করেছিল। কী রকম?
পুলিশই বলছে, গার্ডেনরিচে মুন্না দিনের পর দিন বেআইনি কাজ করেও শাসকদলের নেতা হওয়ার সুবাদে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছিলেন। এমনকী, মুন্নার অবৈধ নির্মাণের ছবি তুলতে যাওয়া পুলিশ-দলকে কার্যত অপহরণ করে তাঁর অফিসে এনে হেনস্থা করা হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, সেই সময়ে রাজ্যের এক মন্ত্রীও ওখানে গিয়ে পুলিশকর্মীদের অপমান করেন বলে অভিযোগ। পুলিশের এ-ও দাবি, ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচে সাব ইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরী খুন হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে অন্যতম অভিযুক্ত ইবনে সাউদকে পুলিশ ঘটনাস্থলে ধরে ফেললেও মুন্না তাকে জোর করে তখনকার মতো ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। অভিযোগ, তখনও তিনি ওই মন্ত্রীর নাম করেছিলেন। আবার মাঠপুকুর-কাণ্ডে অভিযোগ উঠেছে, ঘটনার আগের দিন, অর্থাৎ ১৯ মার্চ গণ্ডগোলের আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রগতি ময়দান থানার ওসি-কে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ চিঠি দিলেও পুলিশ কোনও গুরুত্ব দেয়নি। ওই চিঠিতে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাওয়ের নাম থাকার জন্যই থানা ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছিল বলে পুলিশেরই একাংশের অভিমত।
বস্তুত গত বছর ফেব্রুয়ারিতে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণের ঘটনা থেকেই পুলিশের কাজে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার একের পর এক অভিযোগ উঠেছে। পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলায় কলকাতা পুলিশের তদানীন্তন গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেনকে বদলি করে দেওয়া হয়। তা ছাড়া কখনও মন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধের জেরে, কখনও বা কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে শাসকদলের কথা না-শোনায় একাধিক থানার ওসি-কে বদলি হতে হয়েছে বলে অভিযোগ। তবে পুলিশ-সূত্রের দাবি, মাঠপুকুর-কাণ্ডে কর্তব্যে গাফিলতির জেরেই প্রগতি ময়দান থানার ওসি-কে বদলি করা হয়েছে। ঘটনার অব্যবহিত পরে শম্ভুনাথ কাওকে গ্রেফতারের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।
তা হলে কি পরম্পরা বদলাচ্ছে? পুলিশের একাংশের সংশয় তবু কাটছে না। কেন?
এই মহলের ধারণা, কাজের প্রতিটি পদে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মেনে নিতে নিতে পুলিশের তলানিতে ঠেকে যাওয়া মনোবল চাঙ্গা করতে সরকার হয়তো কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ভেবেছে, যার ইঙ্গিত রয়েছে পুলিশ কমিশনারের কথায়। কিন্তু এটা নিছক মুখ বাঁচাতে ঠেকা দেওয়ার প্রয়াস, নাকি স্থায়ী বন্দোবস্ত, তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন লালবাজারের অনেক অফিসারই। তাঁদের এক জন বলছেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাতে থানায় হাজির হয়ে ধৃতদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ঘটনাও কলকাতা দেখেছে। তাই কত দিন পুলিশকে পুলিশের মতো কাজ করতে দেওয়া হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.