ছোট ছোট সিল করা প্যাকেটে রংবেরঙের আবির। বাজারে সেটাই বিকোচ্ছে ‘ভেষজ আবির’ নামে। কেউ কেউ আবার একে ‘চাইনিজ ভেষজ আবির’ও বলছেন। দোকানে বস্তায় রাখা আবিরের তুলনায় ওই ছোট প্যাকেটের আবিরই বিক্রি হচ্ছে বেশি। বড়বাজার থেকে শিয়ালদহ, লেক মার্কেট থেকে উল্টোডাঙা সর্বত্রই ছবিটা এক। বিক্রেতারা জানালেন, এ বারের দোলে এই ‘ন্যানো প্যাক’-এর আবিরের চাহিদা বেশ ভাল। ছোট প্যাকেটের দামও কম, পনেরো থেকে কুড়ি টাকা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ‘ভেষজ আবির’ বলে যে আবির বাজারে বিক্রি হচ্ছে, সেটা কি সত্যিই ভেষজ?
বড়বাজার, মানিকতলা, কলেজ স্ট্রিট ও উল্টোডাঙার বাজারে ‘ভেষজ আবির’ নামে ছোট প্যাকেটে যে আবির বিক্রি হচ্ছে, তার কিছু নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের পরীক্ষাগারে। রসায়ন বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক সুভাষ ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে তা পরীক্ষা হল। একটি টেস্ট টিউবে কিছুটা ভেষজ আবির ঢেলে তাতে অ্যাসিড দেওয়া হল। পরীক্ষায় দেখা গেল, কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্রবণের রং পাল্টে আবিরের সবুজ রং হয়ে গেল হলুদ। টেস্ট টিউবের নীচে জমল সাদা গুঁড়ো। টেস্ট টিউবটিকে নাকের কাছে এনে সামান্য ঝাঁঝালো গন্ধও পাওয়া গেল। অন্য নমুনাগুলিতেও একই ফল পাওয়া গেল। পরীক্ষার শেষে সুভাষবাবু বললেন, ‘‘পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ওই আবিরে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড বা চুন জাতীয় কিছু মেশানো হয়েছে। অর্থাৎ, আবিরে রাসায়নিক রং রয়েছে। এই আবির যদি শুধু ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি হত, তা হলে তা অ্যাসিডে দ্রবীভূত হয়ে যেত। দ্রবণের রংটাও অনেক ফ্যাকাসে হয়ে যেত।’’ |
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে চলছে আবির যাচাই। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র। |
গত কয়েক বছর ধরে বাজারে ভেষজ আবির বলে সাধারণত যে আবির আসে, তা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় তৈরি। এই আবিরের দাম বেশ বেশি। গত পাঁচ বছর ধরে এই ভেষজ আবির নিয়ে গবেষণা ও প্রচার করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বিদ্যুৎ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘আমরা যে ভেষজ আবির বিক্রি করছি, তার দাম প্রতি প্যাকেট পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা। দাম বেশি হলেও কিছু মানুষের কাছে এর চাহিদা আছে বরাবরই।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক তথা প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর সিদ্ধার্থ দত্তের উদ্যোগে বছর পাঁচ আগে ভেষজ আবির তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘‘ফুলের নির্যাস থেকে আবির তৈরি করে আমরা তার নাম দিয়েছিলাম ভেষজ আবির। এই ভেষজ আবিরে কোনও ধরনের রাসায়নিক মেশানো হয় না। ফলে ওই আবিরের রংটাও হয় খুব হাল্কা।’’
সিদ্ধার্থবাবু জানান, দামি ট্যালকম পাউডার মেশানো হয় এই আবিরে। সেই সঙ্গে ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি বলে এই আবিরের গন্ধও সাধারণ আবিরের তুলনায় অনেকটাই বেশি এবং শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর নয়।
সিদ্ধার্থবাবু বলেন, ‘‘বাজারে ভেষজ আবিরের নামে যে আবির বিক্রি হচ্ছে, তা আদৌ ভেষজ নয় বলে আমাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে। আমরা বেশ কিছু নমুনাও পেয়েছি। ওই আবির প্রাথমিক ভাবে দেখে মনে হয়েছে ভেষজ নয়। কারণ, এই আবিরের রং অনেক বেশি উজ্জ্বল। ভেষজ আবিরের রং এত উজ্জ্বল হতে পারে না। পরীক্ষা করলেই এই আবির ভেষজ কি না, তা প্রমাণিত হবে।’’
ভেষজ আবিরের নামে দেদার বিক্রি হওয়া আবির নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও। তবে তারা এখনও কোনও নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেনি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয়কান্তি দত্ত বলেন, ‘‘আমাদের কাছে সম্প্রতি এ রকম অভিযোগ এসেছে। আমরা আজ-কালের মধ্যেই কয়েকটি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করব। তার পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |