বিয়ের পর কেবলই রান্নাবান্না, স্বামী-সন্তান আর শ্বশুরবাড়ির মন জুগিয়ে চলার দিন শেষ।
বাঁধা-ধরা ছক ভেঙে ডেবরা ব্লকের চকনরসিংহ গ্রামের দে পরিবারের বধূরা তৈরি করেছেন নাটকের দল। পুরোপুরি পুরুষবর্জিত, নাম ‘সঙ্ঘ জননী’। পঁচিশে বৈশাখ থেকে ১৫ অগস্ট, দুর্গাপুজো থেকে দোলযাত্রা সমস্ত অনুষ্ঠানেই আছেন তাঁরা। কোনও সময়ে গান, তো কখনও নাটক।
কাল, বুধবার দোল।
অন্য বছরের মতো এ বারও নাটক করবেন ওঁরা। নাটকের নাম ‘দৃষ্টিদান’। জোরকদমে মহড়া চলছে এখন। কাঁঠালপাতা দড়িতে বেঁধে তৈরি করা হয়েছে নকল লাউডস্পিকার। যাতে মঞ্চের কোন জায়গায় কাকে দাঁড়াতে হবে তা সহজেই বোঝা যায়। নাটক এক ছাত্রীকে নিয়ে। তার পড়াশোনায় মন নেই। কিন্তু সাহসী, সৎ, পরোপকারী। মেধাবী ছাত্রীরা শিক্ষিকাদের চোখের মণি। কিন্তু তাকে সহ্য করতে হয় লাঞ্ছনা। পরবর্তী কালে কিন্তু সে-ই চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রধান শিক্ষিকাকে নিজের চোখ দিয়ে সাহায্য করে। অথচ, মেধাবী ছাত্রীটি বড় চাকরি পেয়েও প্রধান শিক্ষিকাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। ‘সময় নেই’ বলে চলে যায়। |
প্রধান শিক্ষিকার ভূমিকায় রয়েছেন কৃষ্ণা দে। বাস্তবে যিনি এমএ-বিএড পাশ করেছেন, ডিগ্রি নিয়েছেন কর্মশিক্ষাতেও। স্কুলে পড়ানোর ভীষণ ইচ্ছে এখনও। তাঁর আফশোস, “অনেক পরীক্ষা দিয়েছি। তবু হয়নি। এ বারও পরীক্ষা দেব।” তাঁর শাশুড়ি ষাটোর্ধ্ব গোপা দে নাটকে ঝি। বাস্তবে যিনি পাড়া মাতিয়ে রাখেন সেই ৫৬ বছরের শিখা দে আবার নাটকে গম্ভীর, অর্থলোভী বাড়িওয়ালি। হাসতে-হাসতে শিখাদেবী বলেন, “আমি মঞ্চে উঠলেই সব দর্শক চুপ হয়ে যায়। বলে চুপ, চুপ, ঠাকুমা উঠছে রে। দেখি কী করে।”
মাধ্যমিক পাশ করা আরতি দে রয়েছেন স্কুল ইনস্পেক্টরের ভূমিকায়। তাঁর কথায়, “আমাদের ছয় বোন এক ভাইয়ের সংসার। বাবা একার রোজগারে সবাইকে পড়াতে পারেননি। তাই উচ্চশিক্ষা না পেলেও নাটকে স্কুল ইনস্পেক্টর হয়ে আমি খুব খুশি।” আবার জিএনএম পাশ করা বেলা দে সাজছেন চিকিৎসক। তিনি বলেন, “বাস্তবে সংসারের জন্য নার্সের চাকরি পেয়েও করতে পারিনি। নাটকে ডাক্তার সেজে কিছুটা ইচ্ছেপূরণ করে নিই।”
এক কথায় এ যেন ইচ্ছেপূরণের মঞ্চ। যে মঞ্চ সারা দিনের রান্নাবাড়া, সংসারের সব রকম চাপ থেকে মহিলাদের মুক্তি দিয়ে সাংস্কৃতিক বাতাবরণও তৈরি করে গ্রাম জুড়ে। আর এই কারণেই বাধা দেওয়া দূরে থাক, বাড়ির পুরুষেরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণার স্বামী রজত দে কাজ করেন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে। তিনি বলেন, “ওদের থেকে আমাদের আনন্দ বেশি হয়। ওরা এই সংস্কৃতি-চর্চা চালিয়ে গেলে পরবর্তী প্রজন্ম নতুন কিছু শিখতে পারবে।” নাটকের আর কুশীলব অপর্ণা দে-র স্বামী প্রদীপ দে ডাক বিভাগের কর্মী। তাঁর কথায়, “ওরা যখন নাটক নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আমরাই সংসার সামলাই।”
ওঁদের এই নাটক দেখতে কেবল গ্রামের নন, আশপাশের এলাকার মানুষও ভিড় জমান। কে জানে, সঙ্ঘ জননীর অনুপ্রেরণায় হয়তো গ্রামবাংলার অন্য কোনওখানে তৈরি হচ্ছে আরও একটা ইচ্ছেপূরণের দল। |