বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নেট-হেনস্থায় জীবন
জেরবার কচি-কাঁচাদের

বাস্কেটবলে উঁচু ক্লাসের দাদাদের হেলায় টেক্কা দেওয়া সুমন এখন আর মাঠেই যায় না। বরং শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকে বসে থাকতে দেখা যায় মনোবিদের চেম্বারে।
বন্ধুদের সঙ্গে এক সঙ্গে ছবি তুলেছিল প্রশান্ত। কিন্তু কম্পিউটারে অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু এক সহপাঠিনীর সঙ্গে তার ছবি আপলোড করে দিয়েছিল তাদেরই বন্ধু। রাগ মেটাতে পেপার কাটার দিয়ে যার আঙুল কেটে দিয়েছে প্রশান্ত।
একই রকম হেনস্থার শিকার নূপুর অবশ্য এখন এ সব থেকে অনেক-অনেক দূরে। নেট-দুনিয়ায় আলাপ হওয়া একটি ছেলের হাত ধরেই প্রথম প্রেম এসেছিল তার জীবনে। কিন্তু পরীক্ষার চাপে কয়েক দিন তেমন সময় দিতে না পারায় নিজেদের যাবতীয় ব্যক্তিগত কথোপকথন (চ্যাট) সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে তুলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল সেই ‘বয়ফ্রেন্ড’। নূপুর আত্মহত্যা করেছিল।
তিনটি ক্ষেত্রেই নাম কাল্পনিক। কিন্তু ঘটনা সত্যি। এবং এর প্রতিটির জন্যই অভিযোগের আঙুল ‘সাইবার বুলিয়িং’ বা নেট-হেনস্থার দিকে।
ইন্টারনেটে (বিশেষত ফেসবুক, অর্কুট, হাই ফাইভ কিংবা আপনা সার্কেলের মতো সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে) আজকের প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের তীব্র আসক্তি যে তাদের বিভিন্ন মানসিক সমস্যার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সেই অভিযোগ নতুন নয়। খুব একটা ছোট নয় সেই অভিযোগের তালিকাও। সাইবার বুলিয়িং এ বার সেই তালিকাতেই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
মনোবিদদের মতে, স্কুলের ঝগড়া, মাঠের রেষারেষি কিংবা ক্লাসের কথা কাটাকাটি এখন সোজা পৌঁছে যাচ্ছে নেটের দুনিয়ায়। সোজাসুজি মুখের উপর দু’কথা শুনিয়ে না দিয়ে কেউ আপলোড করে দিচ্ছে বিকৃত ছবি। কেউ তৈরি করছে ‘হেট গ্রুপ’। কেউ আবার ক্রমাগত খারাপ কথা ছড়িয়ে দিচ্ছে রাগ হওয়া বন্ধু সম্পর্কে।
একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই নেট-হেনস্থার ক্ষেত্রে চিন ও সিঙ্গাপুরের পরেই রয়েছে ভারত। এবং এই সমস্যার সব থেকে বড় শিকার ৮ থেকে ১৭ বছরের স্কুল পড়ুয়ারা। খাস কলকাতাতেই ফি-বছর এই সমস্যা বাড়ছে ৩০% হারে। শুধু তা-ই নয়, এই সমস্যা এখন থাবা বসাতে শুরু করেছে ছোট শহরগুলিতেও।
মানসিক অবসাদ, হিংস্রতা, নিষ্ঠুর মনোভাব থেকে শুরু করে আত্মহত্যার প্রবণতা ছোটদের মধ্যে মারাত্মক সব সমস্যার জন্ম দিচ্ছে নেট বুলিয়িং। মনোবিদ রেশমি দত্তের কথায়, “বাস্তব আর নেট-দুনিয়া মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার কারণেই এই সমস্যা বাড়ছে বিপজ্জনক গতিতে। হয়তো আত্মবিশ্বাসের অভাবে সামনাসামনি কাউকে কড়া কথা বলা যাচ্ছে না। তো রাগ চরিতার্থ করতে ইন্টারনেটকেই মাধ্যম করছে অনেকে। কিন্তু এর ফলে যখন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তখন আর তা সামলানো যাচ্ছে না।” যারা এর শিকার, তারা যেমন অবসাদে ভুগছে, তেমনই যারা এ কাজ করছে, তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এ থেকে আনন্দ পাওয়ার বিকৃত মানসিকতা।
স্কুলে ঝগড়া, রেশ সোশ্যাল সাইটে
হেনস্থার খতিয়ান
• ভারতে অনলাইন বুলিয়িংয়ের শিকার ৫৩% নেট ব্যবহারকারী।
• খাস কলকাতাতেই ফি-বছর এই সমস্যা বাড়ছে ৩০% হারে।
• সন্তানের নেট-হেনস্থার অভিযোগ জানাচ্ছেন ৩২% বাবা-মা।
• ৫৫% ক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙুল নেটওয়ার্কিং সাইটের দিকে।
• মেট্রো শহরে ৪০% টিনএজার মোবাইলে নেট ব্যবহার করে।
• প্রতি মিনিটে নেট অপব্যবহারের শিকার ৮০ জন।
কলকাতার একটি বেসরকারি স্কুলের প্রিন্সিপাল রিতা চট্টোপাধ্যায়ের মতে, নেট-দুনিয়ায় ঢোকার আগে সেখানকার নিয়মকানুন জানতে হবে ছোটদের। পরিণত হতে হবে তাদের দায়িত্ববোধ। তিনি বলেন, “ছোটরা নেট নিয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কমে যাচ্ছে বন্ধুদের মধ্যে মেলামেশা। আমার মতে, দশম শ্রেণী পর্যন্ত কোনও নেটওয়ার্কিং সাইটের সদস্য না হওয়াই ভাল। বরং পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চাদের উত্‌সাহ দেওয়া উচিত খেলাধুলো, গান-বাজনার মতো বাড়তি কিছু করতে।”
শহরেরই আরেকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা জানান, র্যাগিং রুখতে যেমন নিয়মকানুন রয়েছে, তেমনই এ বিষয়েও নির্দিষ্ট দিশা থাকা জরুরি। উল্লেখ্য, গুড়গাঁওয়ের একটি নামী স্কুলে নেটওয়ার্কিং সাইট নিষিদ্ধ। তবে সেই পদক্ষেপ নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। শিক্ষা জগতের প্রশাসনিক মহলে এ নিয়ে সচেতনতার অভাব এখনও স্পষ্ট বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি।
কিন্তু শুধুই সচেতনতার অভাব? না কি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নেট-দুনিয়ায় পা রাখার জন্য অলিখিত কোনও চাপ কাজ করে আজকের পড়ুয়াদের উপর? সদ্য কৈশোরে পা রাখা শ্রেয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মেনে নিচ্ছে, অনেক সময়ই বন্ধু-বান্ধবদের চাপে নেটওয়ার্কিং সাইটের সদস্য হতে হয়। তবে তার মতে, সদস্য হওয়ার পর বাড়ির বড়দের কাছে কিছু বিষয় জেনে নেওয়া ভাল। উচিত নয় যে কোনও ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’-এ হ্যাঁ বলা। ষষ্ঠ শ্রেণীর এই ছাত্রী জানাচ্ছে, অচেনা কারও বন্ধু হয়েই প্রবল বিপদে পড়েছিল তার তিন সহপাঠী। শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সাইটে অভিযোগ দায়ের করে সমস্যা মিটেছে।
তবে আশার কথা হল, সমস্যার প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তত আগের তুলনায় সচেতন হচ্ছেন বাবা-মায়েরা। একটি সফট্ওয়্যার নিরাপত্তা সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, শহরের ৭৭% বাবা-মা বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই সচেতনতাকে পুঁজি করে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও তৈরি করছে প্রযুক্তি সংস্থাগুলি। সংস্থাটির দাবি, এ বার বিভিন্ন ছোট-বড় শহরের স্কুলে এ নিয়ে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করবে তারা।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.