|
|
|
|
|
|
রং বদলায়... |
দেখিলাম, সবুজের দিকেই পাল্লা ভারী। দশ জন যদি সবুজ ছড়ায়,
মাত্র তিন-চারি জন লাল। গৌতম চক্রবর্তী-র চক্ষে কমলাকান্তের ঝাঁকিদর্শন। |
সিদ্ধির মাত্রা একটু বেশি চড়াইলেই এই জগৎসংসার দোল উৎসবের ন্যায় রঙিন মায়াবী বলিয়া বোধ হয়। অহো, আর চার দিন পর আগামী বুধবার সকলে রঙের মৌতাতে মাতিবে। নসীবাবুর বাগানে বসিয়া শুনিলাম, পাড়ায় পাড়ায়, বহুতল কমপ্লেক্সে সকলে এখন হইতে প্রস্তুতি লইতেছে। অমুক ফ্ল্যাটের দাদা, বউদির সহিত কেবল ‘কেমন, ভাল আছেন তো’ গোছের কথাবার্তা হইয়াছে। কিন্তু জানালা দিয়া আড়ালে আবডালে দেখিয়াছি, বউদি হুল্লোড়বাজ, চাম্পি মহিলা। বুধবার ওঁকে কায়দা করিয়া রং দিতেই হইবে। বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা মারিতে গিয়া দেখিয়াছি, উহার বোনটি ‘ক্যাট’, খালি ভাও বাড়ায়। রাস্তায় দেখা হইলে হাসে, কিন্তু সামনাসামনি পাত্তাই দিতে চায় না। বুধবার কায়দা করিয়া, ছম্মকছল্লু, অ্যায়সা রং দিব না!
কিন্তু আমা হেন দরিদ্র ব্রাহ্মণকে কে রং দিবে? ভাবিতে ভাবিতে সিদ্ধি ও আফিমবড়ি খাইয়া রঙের দোকানে প্রবেশ করিলাম। সেখানে তুমুল হইচই, পিচকারি ও বেলুন লইয়া সকলে পরস্পরকে রং ছুড়িতেছে। দেখিলাম, সবুজের দিকেই পাল্লা ভারী। দশ জন যদি সবুজ ছড়ায়, মাত্র তিন-চারি জন লাল। মনে পড়িল, তিন বছর পূর্বেও এই রং-বিপণিতে লালের প্রবল দাপট ছিল। তখন দশ জনের মধ্যে সাত জনই লাল রং লইয়া নাচানাচি করিত, দোল উৎসবে দোকানদার হইতে খরিদ্দার সকলকে রক্তিম আভায় রাঙাইয়া তুলিত।
আজ লালের প্রতাপ গিয়াছে, সংসারে সবই চক্রবৎ পরিবর্তন্তে।
কিন্তু লাল কোথায় হারাইল? দোকানিকে প্রশ্ন করিতে সে হাসিল, ‘‘দেখিতেছেন না, যাহারা লাল ছিল, তাহারা বেশির ভাগই আজ সবুজ হইয়াছে।’’ ভাবিলাম, এ ভারি মজা। লাল কী ভাবে সবুজ হইল, বিশদে জানিতে হইবে। দোকানি জানাইল, তাহার দোকানে ‘ক্ষমতা’ নামক শক্তিশালী এক প্রকার গঁদের আঠা আছে। ওই আঠা ঘষিতে ঘষিতে লাল ক্রমে জৌলুস হারাইয়া ফ্যাকাসে খয়েরি হইয়া গিয়াছিল। ‘‘ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছিল বলিয়াই দ্রুত সবুজ রং করা গেল,’’ বলিলেন দোকানি। আমোদ পাইয়া আঠার শিশিটি দেখিতে চাইলাম। কিন্তু দোকানি জানাইলেন, উহা এখন পিচকিরি, বেলুন শোভিত সবুজের কাছে। |
|
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব |
আমি আঁতকাইয়া গাঢ় সবুজের নিকট ছুটিলাম, “ভাই, আঠাটি সযত্নে ধারণ কর। উহাই রং পচাইয়া দেয়। লালকে পচাইয়া খয়েরি করিয়া দিয়াছিল, তোমাদেরও পচাইয়া হলুদ বা বেগনি করিয়া দিতে পারে।” গাঢ় সবুজ রাগে রক্তচক্ষু হইয়া জানাইলেন, “হিসাব কষা আছে। পচন ধরিতে ৩৪ বছর লাগে। এখন আগামী দশ বছর কোনও কথা বলবি না। চোওওপ!”
ধমক খাইয়া বিপণির পিছনে শেয়ারবাজারে ঢুকিলাম। সেখানেও তুমুল হট্টগোল। দেখিলাম, সেনসেক্সে সবুজের পরই নীল আর সাদার দাম চড়িয়াছে। মনে পড়িল, নসীবাবুর বাগানের সামনে ফুটপাথ, অদূরে ফ্লাইওভারের রেলিং সবই আজ নীল-সাদায় চিত্রিত। প্রসন্নর গরুটি অবশ্য এখনও সাদা। এক বার ওই গরু হারাইলে হতভাগ্য কমলাকান্ত চক্রবর্তীকে সাহেবের এজলাসে সাক্ষ্য দিতে হইয়াছিল। তবে প্রসন্ন এ বার প্রতিশ্রুতি দিয়াছে, দোলের দিন আমাকে শুধু দুগ্ধ পান করিয়া থাকিতে হইবে না। ওই দুগ্ধ হইতে সে পুডিং, ক্যারামেল কাস্টার্ড, ভ্যানিলা আইসক্রিম ইত্যাদি রকমারি খাদ্যসম্ভার প্রস্তুত করিয়া আনিবে। গাঢ় সবুজের আশ্চর্য হিসাববোধ তখনও ভুলিতে পারিতেছি না। তিরিশ নয়, পঁয়তিরিশ নয়, রং পচিতে মাত্র চৌত্রিশ বছর লাগে!
শেয়ারবাজারের একটি কক্ষে প্রবল ভিড়। মাথায় ছিপি আঁটিয়া, সাজিয়াগুজিয়া বসিয়া আছে সিলভার কালার। রুপোলি সুন্দরী চোখ টিপিয়া জানাইল, ‘‘হোলির দিনে আমার ডিমান্ড বুঝিতে পারিতেছ? লাল, নীল, সবুজের পরই আমি।’’ শুনিলাম, হাতে রুপোলি রং লইয়া অনেকেই বন্ধুবান্ধবকে উহা মাখাইয়া দিবে। আমি অবশ্য রুপোলির ঘরে বেশিক্ষণ থাকি নাই। কন্যাটি ছলনাময়ী। উহাদিগের পরিবারে ‘সিলভার টনিক’ নামে আর একটি সুন্দরী কন্যা আছে। শুনিয়াছি, সে নসীবাবুর ব্যাঙ্কে ও কোম্পানির কাগজে থাকে। আমি, দরিদ্র কমলাকান্ত আজীবন ওই টনিকের কথা শুনিয়াই গেলাম, কোনও দিন চাখিবার সুযোগ পাইলাম না।
আজ রুপোলি সুন্দরীর কী দয়া হইল, নিজে থেকেই দিদির কথা তুলিল, ‘‘দা ঠাকুর, সিলভার টনিক দিদির সহিত দেখা হইল?’’ আমি ঘাড় নাড়িলাম, ‘‘কেন, রসিকতা করিতেছ, বোন?’’ রুপোলি জানাইল, ‘‘সবুজের সহিত দেখা কর, কমলাকান্তদা। তুমি শুনিয়াছি ভ্যাগাবন্ড, বেকার। আফিম-টাপিম খাইয়া দিবারাত্র নসীবাবুর বাগানেই পড়িয়া থাকো। সবুজের সঙ্গে দেখা করিয়া এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম তুলিও, সিলভার টনিক পাইবে।’
সবুজ আমাকে কিছুক্ষণ আগে ধমক দিয়াছে, ফের তাহার দ্বারস্থ হইব? গেল বৎসর ভুল করিয়া দেড় ডেলা আফিম খাইয়াছিলাম, তিন দিন ধরিয়া যমে-মানুষে টানাটানি। পরে প্রসন্ন হাসিতে হাসিতে বলিয়াছিল, ‘‘দা-ঠাকুর, আফিম না খাইয়া চোলাই গিলিলেই পারিতে। টনিক জুটিত।’’ আমি বাচাল নারীর কথার প্রত্যুত্তর করি নাই। কিন্তু রঙের বাজার ঘুরিয়া চক্ষু খুলিয়া গিয়াছে। ফের গাঢ় সবুজের নিকটস্থ হইলাম। যদি কিঞ্চিৎ টনিক জোটে! সবুজ শুনিয়া বলিল, ‘‘দিতে তো খুবই ইচ্ছা, কমলাকান্তদা। তোমাকে চিনি, সৎ ব্রাহ্মণ, দিতে পারিলে খুশি হইতাম। কিন্তু লাল হতভাগা চক্রান্ত করিয়া টনিকের বোতল শেষ করিয়া দিয়াছে। এখন ঝাঁকাইয়া, চাপড়াইয়া, খাবলা মারিয়া এখান সেখান থেকে টনিক জোগাড় করিতে হয়। নেহাৎ আমি, তাই কোনওক্রমে চালাইতেছি।’’ |
|
আমি রঙের দোকানির কথা তুলিলাম, ‘‘কিন্তু ফ্যাকাসে লাল-ই তো এখন সবুজ হইয়াছে। সাবধান, ‘ক্ষমতা’ নামক আঠাটি সতর্ক ভাবে ব্যবহার করিও।’’ সবুজ আমার উত্তরীয় ধরিয়া কাছে টানিয়া আনিল, ফিসফিস করিয়া বলিল, ‘‘চক্রান্ত, কমলাকান্তদা। আঠা মানে কী? ইকড়িমিকড়ি। ইকড়িমিকড়ি মানে কী? চামচিকড়ি। চামচিকড়ি মানে কী? চামের কাঁটা মজুমদার, ধেয়ে এল দামোদর। মানে, কোনও কোনও দোকানি চক্রান্ত করছে, কাঁটা হাতে আমার দিকে ধেয়ে আসার প্ল্যান করছে। সব জানি বন্ধু। সব দেখিতেছি, লক্ষ্য রাখিতেছি,’’ বলিতে বলিতে সে অবশিষ্ট জনা কয়েক লালকে রং খেলায় পযুর্দস্ত করিতে ফের দ্রুত পায়ে ফটরফটর হাঁটা দিল।
উত্তরীয় এ রকম চ্যাটচ্যাটে লাগিতেছে কেন? আঠা! সর্বনাশ! এই কি সেই বিপজ্জনক ক্ষমতার আঠা? সবুজও তাহা হইলে উহার ব্যবহার রপ্ত করিতে পারে নাই? আমি দ্রুত ছুটিলাম। কিন্তু রঙের ভিড়ে কোথায় যেন ধাক্কা লাগিল, মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গেলাম।
....প্রসন্ন আসিয়া ঠক করিয়া দুধের ঘটি নামাইয়া দিল, ‘‘দাঠাকুর, খেয়ে নাও। ইস, ফের সিদ্ধিবাটা আর আফিম পাঞ্চ গিলিয়াছ?’’
আমি কোঁ কোঁ করিয়া বলিলাম, ‘‘শুধু দুধ? প্রসন্ন, তুমি যে কাস্টার্ড, পুডিং, আইসক্রিম কত কী দিবে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলে!’’ ‘‘মরণ!’’ প্রসন্ন মুখঝামটা দিল, ‘‘দোলের এখনও চার দিন বাকি, দাঠাকুর। ৯০ পার্সেন্ট দুধ জাল তো দেওয়াই হয়ে গিয়েছে। চার দিন লাগেনি, এক দিনেই করে ফেলেছি। খেয়ো, কাস্টার্ড, পুডিং যত খুশি খেয়ো।’’
অবাক হইয়া দেখিলাম, প্রতিশ্রুতির ঘটিতে সেই চিরন্তন জলমিশ্রিত দুগ্ধ। কেন জানি না, প্রসন্নও আজ সবুজ শাড়ি পরিয়া আসিয়াছে। |
|
|
|
|
|