অজিদের নিয়ে পিকনিক আর
হাসিঠাট্টা দিনান্তে কিছুটা গম্ভীর
দেশে বহু দিনই প্রিন্ট মিডিয়ার মাঠে ঢোকার এক্তিয়ার নেই। উইকেট দেখারও না। ঢুকতে পারেন একমাত্র অফিশিয়াল টিভি চ্যানেলের ভাষ্যকারেরা। তা, সাতসকালে টসের আগেই প্রেসবক্সে ফিরে তাঁরা ম্যাচের ফল ঘোষণা করে দিলেন।
তিন দিন!
কোটলা পিচ নাকি এতটাই ফাটা-ফাটা আর ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় রয়েছে। শেন ওয়াটসন টস জিতলেন। তাতেও এঁদের পূর্বাভাস রদবদলের কোনও লক্ষণ দেখছিলাম না। শেন ওয়ার্ন তো কখন থেকেই প্রকাশ্যে বলে যাচ্ছেন, ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম দৃষ্টান্ত হবে যে, চার বার টস জেতা দল ০-৪ সিরিজ হারল। চুয়াল্লিশতম অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক ওয়াটসন তার আগেই অবশ্য মৃদু একটা রেকর্ড করে বসে রয়েছেন। প্রথম অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক যিনি আগের টেস্টে সাসপেন্ড হয়ে কিনা পরের টেস্টে নেতা! পাকিস্তানি ভাষ্যকারদের পেছনে লাগা শুরু হয়ে গেল, অবধারিত বিশ্বরেকর্ড। কারণ পাকিস্তানেও এমন নমুনা নেই।
উপমহাদেশীয় প্রেসবক্সগুলোতে এমনিতেও ক্যাঁচরম্যাচর আর আওয়াজ লেগে থাকে। ব্যতিক্রম টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনের দু’ঘণ্টা। ওই সময়টা মিডিয়া যথাসম্ভব শান্ত থাকে। মন দিয়ে খেলা দেখে। জরিপ করার চেষ্টা করে, টেস্ট কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? অথচ এ দিন প্রথম বল থেকে চা-বিরতি পর্যন্ত যা চলল, সবচেয়ে ভিড় থাকা মানিকতলার মাছের বাজারেও এর চেয়ে নৈঃশব্দ বিরাজ করে!
সিরিজে ধারাবাহিক ভগ্নদশা অব্যাহত করে ওয়ার্নার চলে গেলেন শূন্য রানে। সবাই যেন আরও নিশ্চিত হয়ে পড়ল, ভবিতব্য কে খণ্ডাবে! নইলে টেস্ট ম্যাচের প্রথম সকাল-দুপুরে এত জমাটি উচ্চস্বরের আড্ডা আর হাসাহাসি ভারত-অস্ট্রেলিয়া কেন, জিম্বাবোয়ে প্রতিপক্ষ হয়ে এলেও কেউ দেখেনি। টিভি ভাষ্যকারেরা প্রিন্ট মিডিয়ার তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি চাপে থাকেন। যেহেতু তাঁদের বিষয়টা লাইভ। আর এক মুহূর্তে কোটি কোটি দর্শকের কাছে পৌঁছচ্ছে।
কোটলার মজলিসে। ছবি: উৎপল সরকার
আজ তাঁদেরও দেখে মনে হল হোলির পর রংচং মেখে ফ্রেন্ডলি ক্রিকেট ম্যাচের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। স্টিভ স্মিথ আর পিটার সিডলের দাঁতে দাঁত চাপা প্রতিআক্রমণ শুরু হওয়ার সামান্যতম ইঙ্গিতও তখন নেই। সঞ্জয় মঞ্জরেকর যাঁকে কমেন্ট্রির সঙ্গে অ্যাঙ্করিংও সামলাতে হয়, তিনি চোখাচোখি হতে হাসলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত এখুনি মিচেল জনসনের উইকেটটা যে ভাবে গেল! অশ্বিনের ক্যারম বল বুঝতে না পেরে জাজমেন্ট দিয়েছিলেন বাঁ-হাতি অস্ট্রেলিয়ান পেসার। বল ভেতরে ঢুকে চকিতে বেল ফেলে দেয়। হতবুদ্ধি মিচেল তখনও ভাবছেন, ধোনির প্যাডে লেগে বেল পড়েছে। ওঁর বিস্ফারিত মুখটাই চলতি সিরিজের প্রতীকী ছবি! অসহায় আউটের এই সব ধরন সচরাচর স্মরণীয় হয়ে থাকে। যার প্রভাব চিরকাল থাকে সুদূরপ্রসারী। সেই আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ইমরান খানের ইন-ডিপার জাজমেন্ট দিয়ে বোল্ড হয়েছিলেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। আজও আশির দশকে ভারতের বিরুদ্ধে পাক আধিপত্যের কথা উঠলে আউটটা ফিরে ফিরে আসে!
মঞ্জরেকর অবশ্য রবিচন্দ্রন অশ্বিন নন। অন্য এক জনকে নিয়ে মুগ্ধ। আর তিনি ইহলোকে নেই। অস্ট্রেলিয়া ও দিকে সাত উইকেটে ১৩৬। কিন্তু সেটা তো বিমানে সফর করলে সিটবেল্ট বাঁধতে হয়-এর মতোই সহজ, স্বাভাবিক ঘটনা। চঞ্চল হওয়ার মতো কী হয়েছে? মঞ্জরেকর যাঁর কণ্ঠ ইউটিউবে শুনে বরং ছটফটে মুগ্ধ হয়ে রয়েছেন, তাঁর নাম শ্যামল মিত্র। “উফ, কী গানটা ওঁর উত্তমকুমারের লিপে ‘আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারা দিন’। কী সুর, কী গায়কী।” বলে মঞ্জরেকর নিজে গাইতে শুরু করলেন।
ধোনি ও দিকে তখন ক্রমাগত বোলার বদলাচ্ছেন। ওঁর ক্যাপ্টেন্সির এই একটা অদ্ভুত স্টাইল! স্পিনার উইকেট পাক বা না পাক, তাকে বারবার বদলান। পটৌডি ঘরানার ঠিক উল্টো। যা বলত, স্পিনারকে লাইন-লেংথ ঠিক করার জন্য টানা বল করাও। তবে তো সে ছন্দ পাবে। এক বার জাডেজা, এক বার ওঝা এত চেঞ্জ করলে কী করে হবে?
জাডেজা অবশ্য অনেক আগেই বিপজ্জনক ওয়াটসনকে পুরো বিভ্রান্ত করে ফিরিয়েছেন। চুটকি ভরা একটা টুইট খুব জনপ্রিয় হয়ে তখন কোটলায় ঘুরছে: অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন তুমি যে-ই হও, ক্লার্ক বা ওয়াটসন। জাডেজার খদ্দের তোমায় হতেই হবে। টিভিতে দেখাচ্ছিল আরও একটা টুইট: ওহে অস্ট্রেলিয়া। কোটলায় চার বার ব্যাট করলে তবে তোমরা বুঝবে কী করে টেস্ট ইনিংস গড়তে হয়।
সামনে ওয়াসিম আক্রম এক প্রবাদপ্রতিম ভারতীয় ক্রিকেটারের সঙ্গে আলোচনামগ্ন। বিষয়? নিশ্চয়ই কোটলার কালো মাটির পিচ আর অজিদের অসহায়তা? ধুর। জাভেদ মিয়াঁদাদ। এই যে আইপিএলে না এসে আক্রম করাচিতে ছেলেদের সঙ্গে থাকবেন, তার মধ্যেই তাঁকে পাক বোর্ডের ক্লিনিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মিয়াঁদাদ। যেটা হবে করাচিতেই। আক্রম টাকার প্রশ্ন তোলামাত্র মিয়াঁদাদ বলেছেন, সে কী! দেশের কাজ করতে টাকা নিবি?
আক্রম অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছেন, তুমি দেশের উপদেষ্টা হয়ে দিব্যি লাখ-লাখ টাকা কামাচ্ছ। আমি নিতে চাইলে সেটা দেশের কাজ!
গল্পগাছা আর পিকনিকের ভরপুর পরিবেশ বদলে গেল দিনান্তে। আচমকাই। টেস্ট প্লেয়ার হিসেবে অস্ট্রেলিয়া যাঁকে হাতেই তোলে না, সেই স্টিভ স্মিথ আঠার মতো আটকে গেলেন। সঙ্গে পিটার সিডল। হঠাৎ দেখা গেল স্পিনারদের বিরুদ্ধে উদ্ধত মারের খেলায় না গিয়ে অস্ট্রেলিয়া যদি ধরে থেকে থেকে মারের বলের জন্য অপেক্ষা করে, ভারতেরই বরং ধৈর্যচ্যুতি ঘটে! শেষ দু’উইকেটে ৯৫ রান দ্বিতীয় নতুন বল এনেও বন্ধ করা যায়নি! আট উইকেটে ২৩১ এখনও যথেষ্ট নয়। তবে উচ্ছল মজলিশে সামান্য ভাবগম্ভীর ভাব আনতে যে সমর্থ সেটাই বা কম কীসের!
কোটলা প্রেসবক্স চারতলায়। শেষ বিকেলে দোতলার ভিআইপি বক্সে দেখলাম হলুদ টি-শার্ট পরিহিত তরুণী দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বক্সের মধ্য থেকে টিমকে চিয়ার করে যাচ্ছেন। কার্যত ফাঁকা এসি বক্সে এত সময় দাঁড়িয়ে থাকাটা বিস্ময়কর। এমন কোনও নাটকীয় মোচড়ও তো ম্যাচে নেই, যা টি-টোয়েন্টি বা ওয়ান ডে হরবখত সাপ্লাই করে থাকে। দিব্যি তো সামনে বসে অজিঙ্ক রাহানের বাবা-মা খেলা দেখছেন। তা হলে এর এত চঞ্চলতা কেন?
জানা গেল, দাঁড়িয়ে থাকাটা কুসংস্কার। যদি মহিলার স্বামী আরও একটা উইকেট নিতে পারেন। মিষ্টি দেখতে দক্ষিণী তরুণী আবার কলকাতাজাত। কালীঘাট রোডে মামার বাড়ি। বললেন, “কলকাতা এলেই নিয়মিত কালীবাড়ি যাই।” জন্মের পর থেকেই অবশ্য সোজা ফিরে যান চেন্নাই। বেড়ে ওঠা-পড়াশোনা-বিয়ে সব সেখানে। মহিলার নাম প্রীতি অশ্বিন। চার উইকেট মাত্র চল্লিশ রানে নিয়ে যাঁর স্বামী গোটা সিরিজের মতোই শুক্রবারও সফলতম বোলার।
রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে অবশ্য পাঁচ উইকেট নেওয়ার জন্য আবার শনিবার হাত ঘোরাতে হবে। সিডলরা সহজে ছাড়নেওয়ালা নন। প্রীতিকে না তুকতাক সফল করার জন্য আরও ঘণ্টাখানেক দাঁড়াতে হয়!

অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস
কাওয়ান বো অশ্বিন ৩৮
ওয়ার্নার ক কোহলি বো ইশান্ত ০
হিউজ বো ইশান্ত ৪৫
ওয়াটসন স্টা ধোনি বো জাডেজা ১৭
স্মিথ ক রাহানে বো অশ্বিন ৪৬
ওয়েড ক বিজয় বো অশ্বিন ২
ম্যাক্সওয়েল ক ইশান্ত বো জাডেজা ১০
জনসন বো অশ্বিন ৩
সিডল ব্যাটিং ৪৭
প্যাটিনসন ব্যাটিং ১১
অতিরিক্ত ১২
মোট ২৩১-৮
পতন: ৪, ৭১, ১০৬, ১১৫, ১১৭, ১২৯, ১৩৬, ১৮৯।
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৯-১-৪৩-০, ইশান্ত ১৪-৩-৩৫-২, অশ্বিন ৩০-১৭-৪০-৪,
প্রজ্ঞান ২৩-৬-৬৭-০, জাডেজা ২২-৬-৩৪-২




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.