শৈলেন বারিক
(প্রয়াত সৌরভ বারিকের বাবা) |
সামনের দিকে যত এগোচ্ছেন, পিছনের দিনগুলো আরও যেন ফিরে আসছে পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রৌঢ়ের জীবনে। সন্ধেয় অফিস থেকে ফিরলে এখন রোজ যেন তাঁর সৌরভকেই খুঁজে পান তিনি। তাঁকে দেখলেই ‘বাবা’ বলে ছুট্টে আসে! সপ্রতিভ, ঝকঝকে সদ্যযুবা সৌরভ নয়। ছেলেবেলার সৌরভ। সেই একই রকমের ছটফটে, চটপটে বাচ্চা! স্কুলের পড়াশোনা, খেলাধুলোয় মেতে থাকা ‘দস্যি’। মায়ের সঙ্গে সেই এক রকম খুনসুটি।
স্ত্রী কবিতা ও শিশুটিকে দেখতে দেখতে শৈলেনবাবু ভাবেন, কে বলবে এ হল কল্লোল। সৌরভ নয়! “তিন বছর আগের আগুনে স্টিফেন কোর্ট থেকে বাঁচার চেষ্টায় ঝুলন্ত কেব্ল ধরে নীচে নামতে গিয়ে হাত ফস্কে সৌরভ তো পড়েছিল শান-বাঁধানো রাস্তায়!” ওই বহুতলের ছ’তলায় এক বেসরকারি সংস্থার অফিসে চাকরি করতেন ২১ বছরের বি-কম পাশ তরুণ। সন্ধেয় বেসরকারি হাসপাতালে যাঁর নিথর দেহটা খুঁজে পান বারিক দম্পতি। পাঁচ বছরের দত্তক-সন্তান কল্লোলই এখন শৈলেন-কবিতার ভবিষ্যৎ।
মাঝবয়সী স্বামী-স্ত্রী ভাবেননি, আর কোনও দিন শিশুসন্তানের উত্তাপ তাঁদের জীবন স্পর্শ করবে। কিন্তু ভাবতে হল। কবিতার চরম মানসিক অবসাদের ওষুধ খুঁজতেই ডাক্তারেরা বলেন সন্তানের কথা। স্টিফেন কোর্টের ঘটনার এক বছর দু’মাস বাদে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে মিলল দত্তক-সন্তান।
সৌরভকে হারানোর ক্ষতটা তা বলে ভুলে যাননি শৈলেনবাবু। ফাঁক পেলেই চলে যান স্টিফেন কোর্টে। লালবাজারের অফিসারদের থেকে নিয়মিত খবর নেন, মামলাটা কোর্টে উঠল কি না! বহুতলের লিজ-মালিক সংস্থার তৎকালীন ডিরেক্টর সঞ্জয় বাগারিয়া-সহ অভিযুক্তেরা জামিনে বাইরে। শৈলেনবাবু বলেন, “আমাদের মতো হতভাগ্য আত্মীয়েরা কেউ-কেউ স্রেফ দু’লক্ষ টাকার সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। তরতাজা জোয়ান ছেলেমেয়েকে হারানোর বিচারটা কবে পাব, বলতে পারেন?”
প্রতিরক্ষা দফতরের ওই কর্মচারী এখন দু’চোখ ভরে দেখেন, ছোট্ট কল্লোল ‘দাদা’র ছবিকে চকোলেট খাওয়াচ্ছে। ইছাপুরের বাড়িতে সেই কল্লোলকে আঁকড়ে ধরেই এগিয়ে চলেছে পুত্রহারা দম্পতির জীবন।
|
কিষাণকুমার শাহ
(ঘরছাড়া পরিবারের কর্তা) |
তিন বছর আগের বিধ্বংসী আগুনও স্টিফেন কোর্ট থেকে আলাদা করতে পারেনি তাঁকে। রোজ বেলা ন’টার মধ্যে হাঁফাতে হাঁফাতে ঠিক চেনা উঠোনটায় হাজির হবেন বৃদ্ধ। রোদ এড়াতে কখনও দু’নম্বর লিফ্টের দিকে দারোয়ানের ছাউনির নীচে বসেন তিনি। কোনও দিন বা কোল্যাপসিব্ল গেটের সামনে রোয়াকের সিঁড়িতেই জিরোতে থাকেন। এ ভাবেই ঠায় বসে বিকেল চারটে পর্যন্ত কাবার করে দেন কিষাণকুমার। যতক্ষণ না, উল্টো দিকের ফুটে কারনানি ম্যানসনের ‘হ্যারো হলে’ নাতির স্কুল ছুটি হচ্ছে।
৫০ বছরেরও বেশি শাহ পরিবারের ঠিকানা এই স্টিফেন কোর্ট। কিষাণ শাহের বাবা স্টিফেন কোর্ট লিমিটেডে কাজ করতেন। সেই সুবাদেই ছ’তলার ফ্ল্যাটটার ভাড়াটে। তিন বছর আগের আগুনের পরে দুই ছেলে, তাঁদের পরিবার ও স্ত্রীকে নিয়ে কিছু দিন হেদুয়ায় শ্যালকের ফ্ল্যাটে ছিলেন। কিন্তু শ্যালকের ছেলের বিয়ের পরে সেই আশ্রয় গিয়েছে। এখন এক ছেলের শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক বন্ধুর ফ্ল্যাটে ঠাঁই মিলেছে লেকটাউনে। রোজ সকালে দুই নাতিকে স্কুলে পৌঁছতে প্রবীণ গৃহকর্তা কিষাণকেই বেরোতে হয়। তাদের ছুটি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন স্টিফেন কোর্টেই।
কোনও কোনও দিন স্ত্রী চম্পাও কিষাণের সঙ্গে আসেন। উঁচুতে ফ্ল্যাটের বন্ধ জানলার গ্রিলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন দু’জনে। ওই ফ্ল্যাটের ক্ষতি হয়নি ছিটেফোঁটা। কিন্তু বহুতলের অংশ ভেঙে নতুন করে সারানো হচ্ছে। কিষাণ বলছিলেন, “যা অবস্থা, লিফ্ট বা ঘরে আলো-পাখা ছাড়াই এই ফ্ল্যাটে ঢুকতে রাজি আছি।” লেকটাউনে কুটুমবাড়ির পরিচিতদের ফ্ল্যাট ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ছাড়তে হবে।
একদা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন কিষাণ। এখন কার্যত রোজগার নেই। দুই ছেলে দু’টি শপিং মলে দোকানের কর্মচারী। স্টিফেন কোর্টের ফ্ল্যাট-মালিককে মাসে মাসে ভাড়া দেওয়া ছাড়াও বহুতলটির সংস্কারে দরকারি টাকা যতটা সম্ভব, আবাসিকদের অ্যাসোসিয়েশন-কে দিয়ে যাচ্ছে শাহ পরিবার। অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা দেবাশিস গুহনিয়োগীকে আকুল হয়ে রোজই ফোন করেন চম্পা।
চম্পা-কিষাণের মতো বিপন্নদের চেষ্টায় বহুতলের বিপজ্জনক অংশ অনেকটাই সারাই হয়েছে। সিঁড়ি-মেঝে ঢালাই শেষ। কয়েক জন বাদ দিলে ভাড়াটে বা ফ্ল্যাট-মালিকেরা এখন এককাট্টা। দমকলের ডিরেক্টর তপন ঘোষ জানান, বহুতলের বাসিন্দাদের কাছ থেকে অগ্নি-সুরক্ষা তথা বিকল্প সিঁড়ি তৈরির নকশাও তাঁরা পেয়েছেন। এখন অপেক্ষা দমকলের পরিদর্শনের। তার পরেই বাকি কাজ সারা যাবে। ঘরছাড়ারা সে-দিকেই তাকিয়ে।
|
হুমায়ুন কবির
(জ্বলন্ত বহুতল থেকে উদ্ধার পাওয়া যুবক) |
নদিয়ার অজ গাঁয়ে নলেন গুড়ের খোঁজে খেজুর গাছে চড়ার বিদ্যেটা ভালই রপ্ত ছিল তাঁর। তবু কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে তা যে কোনওদিন কাজে আসবে, স্বপ্নেও ভাবেননি বছর তিরিশের ছিপছিপে তরুণ।
তিন বছর আগের দুপুরে বহুতলটা যে আগুনের গ্রাসে চলে গিয়েছে, পাঁচতলার বদ্ধ অফিসে বসে তা টের পাননি ওঁরা কেউই। যখন বুঝলেন, তখন চারপাশে এসি মেশিন ফাটার বিকট শব্দ, বিষাক্ত ধোঁয়া ঠেলে সিঁড়ি অবধি এগোনোই অসম্ভব। হাতুড়ির ঘায়ে বাথরুমের দিকের বন্ধ জানলাটা তবু ভাঙতে পেরেছিলেন হুমায়ুন। অফিসের ম্যানেজার, প্রায় ১০০ কেজি ওজনের এক যুবককে ঘাড়ে করে বার করার চেষ্টাও করেন তিনি। জানলার ও পাশে বাঁচার সম্বল নারকেল গাছটাও তখনই চোখে পড়ে।
ম্যানেজার অবশ্য গাছে চড়তে পারেননি। তাই দমকলের অপেক্ষায় তাঁকে কার্নিশে বসিয়েই গাছটা আঁকড়ে ধরেন হুমায়ুন। মনে পড়ছিল কৈশোরের কথা। নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় গোয়ালচাঁদপুর গ্রামে কী ভাবে খেজুর গাছ চেঁছে রসের হাঁড়ি ঝুলিয়ে নেমে আসতেন। পরের দিন ফের হাঁড়ি নামাতে হতো। সে-কথা ভাবতে ভাবতেই সে দিন প্রাণ নিয়ে নারকেল গাছ বেয়ে নেমে আসেন হুমায়ুন। একটু বাদেই ধুপ করে শব্দ। টাল রাখতে না-পেরে পড়ে মারা যান তাঁর সহকর্মী ম্যানেজার। সে দৃশ্য হুমায়ুন এখনও ভুলতে পারেন না।
হুমায়ুন ও সেই নারকেল গাছ দু’জনেই এখনও স্টিফেন কোর্টে। হুমায়ুন স্টিফেন কোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের কেয়ারটেকার-কাম-দারোয়ান। গাছটার মাথা আগুনে নিশ্চিহ্ন। বহুতল সারাইয়ের সময়ে উপরে উঠে আজও জানলা দিয়ে গাছটাকে দেখেন হুমায়ুন। ক্লাস টেন-পাশ যুবক ২০০২ থেকেই স্টিফেন কোর্টে অফিসে রাতে থাকতেন। এখন কেয়ারটেকার হওয়ার পরেও একতলার একটি অফিস-ঘরে ঘুমোন। মিস্ত্রিদের পয়সা দিয়ে তাঁদের কাছেই ডাল-ভাত খেয়ে নেন। হুমায়ুনেরও স্বপ্ন, স্টিফেন কোর্ট এক দিন আগের মতোই গমগম করবে। তাঁর জীবনও যে বহুতলটির সঙ্গেই চিরতরে বাঁধা পড়েছে।
|