বাজেটের তথ্যের সঙ্গে আর্থিক সমীক্ষার পরিসংখ্যান মিলছিল না। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিধানসভায় জানালেন, বাজেটের তথ্যই ঠিক। আর্থিক সমীক্ষার সঙ্গে সেই তথ্য না-মেলায় সমন্বয়ের ‘ভুলে’র কথা কবুল করে নিলেন। সংখ্যার ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথাও বললেন শিল্পমন্ত্রী।
কিন্তু একই দিনে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রশ্নের জবাবে রাজ্যে বিনিয়োগ নিয়ে বিধানসভায় যে তথ্য পেশ করলেন স্বয়ং শিল্পমন্ত্রীই, তাকে মাপকাঠি ধরলে বাজেটের তথ্যের বাস্তবতা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে!
দিনের শেষে নিটফল তাই দাঁড়াল বিভ্রান্তি!
যেমন হয়েছিল কর্মসংস্থান, রাস্তা তৈরির তথ্য নিয়ে, বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়েও তারই পুনরাবৃত্তি হল। যার জেরে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু বললেন, “ডান হাত কী করছে, বাঁ হাত জানে না। হাত কী করছে, মস্তিষ্ক জানে না! সরকার নিজেরা বিভ্রান্ত! বিধানসভা এবং মানুষকেও তারা বিভ্রান্ত করছে!” |
সূর্যবাবুর প্রশ্ন ছিল, ২০১২ সালের ১ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে কত বিনিয়োগ হয়েছে? জবাবে শিল্পমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইস্পাত, প্লাস্টিক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বস্ত্র, সিমেন্ট, লৌহ-ইস্পাত ইত্যাদি বিভিন্ন শিল্পখাতে এই সময়ের মধ্যে ৮৫০৭.৭২ কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব এসেছে। তার মধ্যে ২১০৮.১৪ কোটির লগ্নি ইতিমধ্যেই কার্যকর।
রাজ্যে ২০১২-১৩ সালের আর্থিক সমীক্ষায় অবশ্য ১২টি প্রকল্পে ৩১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছিল! যে পরিসংখ্যানে ঘাটতি ছিল বলে এ দিন শিল্পমন্ত্রী কবুল করেছেন। তার সঙ্গেই বলেছেন, “বাজেটে অমিত মিত্র যা বলেছেন, আমি সেটাই সমর্থন করছি।” যার মানে হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ২২ মাসের জমানায় রাজ্যে ১ লক্ষ ১২ হাজার ৭৬৯.৩৬ কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাব এসেছে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে যদি বাজেটের ওই তথ্য (যা রাজ্যপালের ভাষণেও ছিল) এবং শিল্পমন্ত্রীর এ দিনের দেওয়া তথ্য দু’টোই সত্যি হয়, তা হলে ২০১২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে এসেছে ৮৫০৭ কোটি টাকার প্রস্তাব। এই জমানার বাকি ১২ মাসে প্রায় ১ লক্ষ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব তা হলে এল কোন মন্ত্রে?
বিরোধী দলনেতার প্রতিক্রিয়া, “বাজেটও সত্যি, উনিও সত্যি! এখন এতগুলো সত্যি এল যে, কোনটা আসল সত্যি, বোঝা মুশকিল!” সরকারি পরিসংখ্যানেই এত ফারাকের কথা তুলে সভার বাইরে সরব হয়েছেন কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়াও। আর খোদ শিল্পমন্ত্রী সভার বাইরে মিডিয়া সেন্টারে দীর্ঘ সাংবাদিক সম্মেলনে এই তথ্যের অসঙ্গতি সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবই দিতে চাননি!
বিধানসভায় জবাব দিতে উঠে এ দিন আর্থিক সমীক্ষার পরিসংখ্যানে ভুল কবুল করে নেন শিল্পমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “বিভাগীয় পরিসংখ্যানে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সে দায়িত্ব আমারও। বিভাগের প্রধান হিসেবে আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না।” তবে এ দিন সভায় পেশ-করা পরিসংখ্যান অর্থমন্ত্রীর বাজেট-বক্তৃতার হিসেবের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বলে দাবি করেন শিল্পমন্ত্রী। তিনি বলেন, “অর্থমন্ত্রী যা জানতে চেয়েছিলেন, তাঁকে রিপোর্ট দিয়েছি।” প্রসঙ্গত, বাজেট-বক্তৃতায় অমিতবাবু বলেছিলেন, ২০১১-র মে মাস থেকে এ পর্যন্ত ২৫৭টি ইউনিটের জন্য রাজ্য সরকার ১ লক্ষ ১২ হাজার ৭৬৯.৩৬ কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব পেয়েছে।
পার্থবাবু এ দিন জানিয়েছেন, ২০১২-র মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যে যে ৮৫০৭.৭২ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, তার মধ্যে: প্লাস্টিকে ২২৭৬.২৪ কোটি টাকা, খাদ্য ও পানীয়ে ২৬৬.২৮ কোটি টাকা, বস্ত্রে ৫৭১.২১ কোটি টাকা, সিমেন্টে ২২৮৪.১৪ কোটি টাকা, লৌহ-ইস্পাতে ১২০৬.৬৮ কোটি টাকা ও অন্যান্য খাতে ১৯০২.৭৬ কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছে। রুগ্ণ শিল্পগুলি পুনর্গঠনে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন পার্থবাবু। কিন্তু তা হলে সরকারি পরিসংখ্যানেই রাজ্যের এই ‘সাফল্য’কে খাটো করে দেখানো হল কেন? পরে বিধানসভার বাইরে পার্থবাবু বলেন, “এই আর্থিক সমীক্ষা একটি তৃতীয় পক্ষের কাজ। অনেক সময়ে কেন্দ্রীয় বাজেট ও বিভাগীয় পরিসংখ্যানেও এমন গরমিল থেকে যায়। ১২টি প্রকল্পের জন্য ৩১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের হিসেব যে ঠিক হতে পারে না, এ তো সাদা চোখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে!”
সূর্যবাবুর প্রশ্নের জবাবে শিল্পমন্ত্রী এ দিন সভায় শিল্পক্ষেত্রে ২০১১-১২ সালে ৪০টি প্রকল্পে ১১ হাজার ২৩৭ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে বলেও জানিয়েছেন। যার সূত্রে পরে সূর্যবাবু মন্তব্য করেছেন, “কিছুতেই ১০ লক্ষ কর্মসংস্থানের হিসাবে পৌঁছনো যাচ্ছে না!” আবার শিল্পমন্ত্রীর দাবি, তাঁরা আগের বাম সরকারের মতো ‘ফাঁপা দাবি’র ভিত্তিতে গলা ফাটান না! এখনও পর্যন্ত যে সব প্রকল্পে হাত দেওয়া গিয়েছে, তার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও মেয়াদ তাঁরা স্থির করে দিয়েছেন।
তবু দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে, হাতে রইল বিভ্রান্তি! |