সাতোরির পাসের রংমশালে ছারখার লাল-হলুদ
প্রয়াগ -১ ( র‌্যান্টি)
ইস্টবেঙ্গল -০
মাঝমাঠে মাঝে মাঝেই তৈরি হচ্ছিল চতুষ্কোণ। কখনও সেটা হীরক খন্ডের আকার নিচ্ছিল, কখনও ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছিল রংমশালের মতো। মাঠের নানা প্রান্তে।
স্কোয়ার পাস, লং পাস, উইং দিয়ে ঝাপটা। সাত-আটটা পাস এক সঙ্গে খেলে বিপক্ষকে ধন্দে ফেলে দেওয়ার চতুর কৌশল।
বাসের্লোনা স্টাইল? তিকিতাকা? অতিশয়োক্তি শোনাবে হয়তো। কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর তিন প্রধানের বাইরে কলকাতার একটি টিমের আই এফ এ শিল্ড জয়ের বীর গাথা বলতে হলে পাস-পাস-পাসের নিখুঁত স্ট্র্যাটেজির কথা লিখতেই হবে। শুধু পাসের বুননেই তো ট্রেভর মর্গ্যানের টিমের ‘অশ্বমেধের ঘোড়া’ মুখ থুবড়ে পড়ল যুবভারতীতে। বুধবার রাতে।
শিলিগুড়ির গ্রুপ লিগের হারের মধুর প্রতিশোধ নিয়ে কলকাতা ফুটবলে সব অর্থেই তৃতীয় শক্তি হয়ে উঠল প্রয়াগ ইউনাইটেড। খুচখাচ বড় ম্যাচ জেতা এতদিন প্রয়াগের কাছে জলভাত ছিল। কিন্তু কলকাতার মাঠে সাফল্য ছিল অধরা। তিন বছর আগে দিল্লিতে ডুরান্ড কাপ জেতাই ছিল তাদের এতদিনের সেরা সাফল্য। এর আগে দু’দুবার আই এফ এ শিল্ডের ফাইনালে উঠেও কাপ ও ঠোটের ফাঁক মেলাতে পারেনি আলো-নবাবের টিম। শেষ পর্যন্ত ডাচ কোচের হাত ধরে শতবর্ষ পেরোনো শিল্ডে জয়ধ্বজা উড়িয়ে দিল ইউনাউটেড।
এলকো সাতোরি যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, তখন জার্মান প্রবাসী এক ফুটবল পাগল বঙ্গসন্তান গ্যালারি থেকে নামছিলেন। বলছিলেন, লিগ কাপে মাস খানেক আগে এরকমই চমকে দিয়েছিলেন সোয়ানসি সিটির মাইকেল লাউড্রপ। চেলসিকে হারিয়ে।
যুদ্ধ শেষের সেনাছাউনি। সাতোরি তখন উড়ছেন।
র‌্যান্টি-কার্লোসরা যখন কোচকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের সমুদ্রে ভাসছেন, তখন মালাগা এফ সি-র কোচ ম্যানুয়েল পালেগ্রিনির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেকেরই। এফ সি পোর্তোকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ আটে তোলার পর যাঁকে নিয়ে লোফালুফি করেছিলেন তাঁর দলের ফুটবলাররা।
প্রয়াগের ডাচ-কোচ এঁদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে চাইছেন না। বরং যোহান ক্রুয়েফ ও পেপ গুয়ার্দিওয়ালার অন্ধ ভক্ত এলকো বারবার তুলে আনছেন, পাসিং ফুটবলের কথা। “আমি জানতাম ইস্টবেঙ্গল একটা সময় ক্নান্ত হবেই। তাই প্রচুর পাস খেলতে বলেছিলাম। আমার স্ট্র্যাটেজি কাজে লেগেছে,” বলছিলেন এলকো।
কিন্তু মর্গ্যানের মতো ধুরন্ধর কোচ কেন ধরতে পারলেন না এলকোর স্ট্র্যাটেজি? তার প্রথম কারণ যদি হয় ফুটবলারদের ক্নান্তি, তা হলে দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই এডে চিডির চোট নিয়ে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে। শনিবারই আই লিগের ম্যাচ। পেশাদার মর্গ্যান তাই সতর্ক। তিনি মানতে চাইছেন না ঠিক, কিন্তু চিডি না থাকায় ম্যাচের আগেই মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ডার্বি ম্যাচে অ্যান্ডু বরিসিচ বিশ্বমানের একটা গোল করতে পারেন, কিন্তু অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার এখনও যে ফিট নন। ম্যাচ জেতানোর ফুটবলার হিসাবে বরিসিচকে ভাবাও ভুল। ফলে বরিসিচ-বলজিৎ জুটি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ল বেলো রজ্জাক-দীপক মণ্ডলদের সামনে এসে।
শিলিগুড়িতে বারো দিন আগে গ্রুপ লিগের ম্যাচে প্রয়াগ বধ করেছিলেন চিডি। জোড়া গোল করে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে হয়েছিল র‌্যান্টি মার্টিন্সকে। প্রচন্ড জেদী নাইজিরিয়ান স্ট্রাইকার ফাইনালে তা ফিরিয়ে দিলেন, হাফ চান্স থেকে অসাধারণ একটি গোল করে। ডেম্পোকে পাঁচটি আই লিগ জিতিয়ে আসা র‌্যান্টির স্বপ্ন পুরণের দিনটা লাল-হলুদের অবশ্য অনেক ভয়ার্ত বার্তা বয়ে আনল। যেমন, পেন ওরজির খেলায় ভাটার টান। রোমিং মিডিও হিসাবে তাঁর খেলা ধরা পড়ে যাচ্ছে বিপক্ষের কাছে। উগা ওপারার বিশাল চেহারাও কাঁপছে চাপে পড়লেই। অফিস-ক্লাব খেলার ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে ক্লান্ত মেহতাব হোসেন ডিফেন্সিভ স্ক্রিন হিসাবে পারছেন না দেখেও মর্গ্যান অসহায়। হাতে পরিবর্ত নেই। লাল-হলুদ কোচের ‘পরিবর্তন’-ও বিপক্ষ কোচেদের কাছে প্রত্যাশিত হয়ে যাচ্ছে।
বিক্ষতদের সামনে নিথর মর্গ্যান।
এ বছর সতেরো কোটি টাকায় দেশের সবথেকে দামি টিম গড়েও প্রয়াগের সাফল্য ছিল না। আই লিগে সাতে। কলকাতা লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে প্রচণ্ড চাপে ছিলেন ক্লাব কর্তারা। ভাড়া করা তাঁবু-মাঠ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো জন-সমর্থন নেই। স্টেডিয়ামে চল্লিশ হাজারের দর্শকের মধ্যে তাদের হয়ে গলা ফাটানোর জন্য ছিলেন সাকুল্যে শ’পাঁচেক। তা-ও তারা ভয়ে বেগুনি-হলুদ পতাকা লুকিয়ে রেখেছিলেন পকেটে। যুবভারতী জুড়ে শুধুই ছিল লাল-হলুদ পতাকা। দোলের আগেই ওড়ানোর জন্য আবির। কিন্তু বেগুনি আবির-ই উড়েছে শেষপর্যন্ত। প্রয়াগ অধিনায়ক দীপক মণ্ডল বলছিলেন, “কোচ আমাদের বলেছিলেন হীনমন্যতায় না ভুগে ফিফটি-ফিফটি বলেও লড়তে। সেটা কাজে লেগেছে।”
স্টেডিয়ামের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও কোচের বেঁধে দেওয়া ৪-১-২-১-২ এর স্ট্র্যাটেজিতে গোলমেশিন র‌্যান্টি, বিশ্বকাপার কার্লোস, লালকমল, দীপক, সংগ্রাম, আসিফরা প্রতি সেকেন্ড দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছেন। আলো ছড়িয়েছেন। ফানেল তৈরি করে লাল-হলুদের সব আক্রমণ এনে ফেলেছেন হীরক-জালের চতুষ্কোণে। প্রথমার্ধটা পেন-খাবরা-মেহতাবরা লড়লেও বিরতির পর ইস্টবেঙ্গলকে প্রায় কোনঠাসা করে ফেলেছিল এলকোর দল। পাসের ফুলঝুরিতে আছন্ন মর্গ্যান শেষ পর্যন্ত চিডি-নওবাকে নামিয়েও সামাল দিতে পারেননি।
ডার্বি ম্যাচ জেতার পর বড় টিম জেতে না। এই ‘মিথ’ ভাঙতে পারলেন না সাহেব কোচও। গাড়িতে ওঠার আগে বলে গেলেন, “এ বার পারলাম না। পরের বার দেখব ইতিহাস বদলানো যায় কী না।”
বেগুনি-আলোর দিনে এর বাইরে আর কী-ই বলার আছে ট্রেভর মর্গ্যানের।

শৈলেন মান্না ট্রফি ( ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট) — বেলো রজ্জাক
ম্যাচের সেরা — র‌্যান্টি মার্টিন্স
রহিম সাহেব ট্রফি (সেরা কোচ)— এলকো সাতোরি

প্রয়াগ:
সংগ্রাম, দীপক, বেলো, গৌরমাঙ্গি, সুখেন, লালকমল, জেমস (তুলুঙ্গা) (শঙ্কর), আসিফ, কার্লোস, রফিক, র‌্যান্টি (ভিনসেন্ট)

ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, খাবরা, উগা, গুরবিন্দার, সৌমিক, লালরিন্দিকা (নওবা), সঞ্জু, মেহতাব, পেন (চিডি), বলজিৎ (রবিন) বরিসিচ।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.