|
|
|
|
|
|
চূড়ায় লাভ |
বেস ক্যাম্প পিছনে ফেলে আপনি যত শৃঙ্গের কাছাকাছি, ততই কমে আসবে অক্সিজেন। ভয় বাড়বে খাদে পড়ার।
পাহাড়ে চড়ার এই ব্যাকরণ সত্যি শেয়ার বাজারের ক্ষেত্রেও। তাই বাজার যত চূড়ার কাছাকাছি,
ততটাই কৌশলী হতে হবে শেয়ার বাছার বিষয়ে। উপায় বাতলালেন ধীর কোঠারী |
এখন বেশ কিছু দিনই শেয়ার বাজারের পায়ের তলায় সর্ষে। এই লেখা জমা দেওয়ার দিন পর্যন্ত দু’বছরের সর্বোচ্চ অঙ্কের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেনসেক্স। এমনকী, ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে বাজার যে সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছিল, তা-ও আর মাত্র কয়েক পা দূরে। অথচ সেই ‘মন ভাল করে দেওয়া’ পরিস্থিতিতেও সাধারণ লগ্নিকারীদের দিন কাটছে তীব্র টানাপোড়েনের মধ্যে। মনে তাঁদের অদ্ভুত দোলাচল।
কারণ, বাজার যে এখন ভাল মেজাজেই রয়েছে, তা তাঁরা বিলক্ষণ বুঝছেন। কিন্তু শেয়ারে লগ্নি করার পক্ষে এটা আদৌ সঠিক সময় কি না, সে বিষয়ে তাঁরা অন্ধকারে। ভাবছেন, কোমর বেঁধে যদি টাকা ঢেলেও ফেলি, তাতেই বা ভাল রিটার্নের আশা কতটা? আসুন না, আজ না-হয় এই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলতে একটু আলাপ-আলোচনায় বসি আমরা। ঝালিয়ে নিই উঁচু বাজারের উপযুক্ত লগ্নি-কৌশল। |
|
দ্বিধা কেন?
যাঁরা আনকোরা, তাঁদের মনে হতেই পারে বাজার যখন উপরের দিকে ছুটছে, তখন সেখানে টাকা ঢালতে এত সমস্যা কোথায়? উত্তর হল, শেয়ার বাজার যত উপরের দিকে পৌঁছয়, সেখানে ঝুঁকির মাত্রাও তত বাড়ে। কারণ, সূচক যত উপরে উঠবে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে তা পতনের সম্ভাবনা। একই কথা প্রযোজ্য বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার দরের ক্ষেত্রেও। তাই এই বাজারে লগ্নি করতে একটু বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে আপনাকে।
মাথার দিব্যি না কি?
একটা উচ্চতায় পৌঁছলেই সূচক পড়বে কিংবা কোনও শেয়ারের দাম নীচের দিকে গড়াতে শুরু করবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা আছে না কি?
অবশ্যই না। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, বাজার তরতরিয়ে বেশ কিছুটা উঠে পড়ার পর (বিশেষত তা চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছলে), তখন লাভের কড়ি ঘরে তুলতে হাতের শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করেন অনেকে। যাকে আমরা বলি স্বাভাবিক সংশোধন (কারেকশন)। কারণ, তখন লগ্নিকারীদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করে সংশয়। তাঁরা ভাবেন, এর পর যদি ধস নামে? যদি ঝুপ করে পড়ে যায় বাজার? কে নেবে সেই ক্ষতির ঝুঁকি? তার থেকে মওকা থাকতেই মুনাফা ঘরে তোলা ভাল।
এ বার সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করুন। মনে করুন, বাজার প্রায় তুঙ্গে থাকার সময়ে কোনও একটি সংস্থার শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নিলেন আপনি। কী করে বুঝবেন, আগামী দিনেও ওই শেয়ারের দাম চড়া-ই থাকবে? কিংবা কী ভাবেই বা বুঝবেন, এর পরও আর হাতের শেয়ার ধরে রাখা উচিত হবে কি না?
প্রথম পরামর্শ
দেখুন, যদি ওসামা বিন লাদেনের মতো কারও পাঠানো বিমান জোড়া-টাওয়ারে ধাক্কা মারে, আর তার জেরে বিশ্ব জুড়ে শেয়ার বাজার হুড়মুড়িয়ে পড়ে, তবে তা আগাম আঁচ করা অসম্ভব। কিন্তু বাজার যখন তুঙ্গে, তখন যে কোনও শেয়ার কেনার ‘প্ররোচনায়’ গা না-ভাসিয়ে একটু কৌশলী হওয়াই যায়।
যেমন, প্রথমেই আঁচ করুন, কাল সূচক পড়লেও কোন কোন সংস্থার শেয়ার দর চাঙ্গা থাকার সম্ভাবনা। দেখুন, পড়তি বাজারেও আপনার মুখ রাখবে কারা। অর্থাত্, শুধু সূচকের দিকে তাকিয়ে শেয়ার কিনবেন না। বরং সংস্থার নিজস্ব আর্থিক জোর, পরিচালন ব্যবস্থার বুনোট, দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে তার আধিপত্য বজায় থাকার সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রাখুন। চড়া বাজারে লগ্নি করার ক্ষেত্রে এটাই আমার প্রথম পরামর্শ। তবে একমাত্র নয়। এ ক্ষেত্রে নীচের বিষয়গুলিও মাথায় রাখুন।
চলুন সহজ পথে
লগ্নি নিয়ে কৌশলের ঘুটি সাজান। কিন্তু এ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা অযথা জটিল করবেন না। দেখবেন বাজার আপনাকে দরাজ হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নীচের বিষয়গুলি মাথায় রাখতেই পারেন
• সঞ্চয়ের কতটা অংশ শেয়ারে লগ্নি করবেন, প্রথমেই সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলুন।
• যে-সব সংস্থার ব্যবসা উঁচু হারে বাড়ছে, শুধুমাত্র তাদের শেয়ারই কিনুন।
• একবারে টাকা না-ঢেলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ছোট ছোট ভাগে ভেঙে লগ্নি করুন। তা হলে এক সঙ্গে সব টাকা জলে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না।
• দীর্ঘ মেয়াদে টাকা লাগান। ধৈর্য ধরুন। রাতারাতি লাভের আশা না- করাই ভাল।
• যত দিন না আশানুরূপ লাভ করছেন, তত দিন ওই শেয়ারে রাখা টাকায় হাত দেবেন না।
আসুন, এ বার এই টোটকাগুলো নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করি।
‘কিস্তি’তে লগ্নি
ছোট ছোট ভাগে দফায় দফায় বিনিয়োগ করুন। চাইলে একটি করে শেয়ারও কিনতে পারেন। এতে কখনও কোনও শেয়ারের জন্য এক সময়ে একটু বেশি দাম দিতে হল, তো পরের দফায় কম দামে তা কেনার সুযোগ পেতে পারেন। ফলে আপনার শেয়ার কেনার গড় খরচ কমবে। সীমিত অর্থ নিয়ে শেয়ার বাজারের মাঠে নামা লগ্নিকারীদের জন্য এই দাওয়াই বেশ কার্যকরী।
উদাহরণ
ধরুন, বাজারে ঢালতে আপনার পুঁজি এক লক্ষ টাকা। তা হলে ওই তহবিলকেই ভেঙে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ৫ হাজার করে লগ্নি করুন।
|
|
যাঁরা বেশ সাবধানী
বাড়তি ঝুঁকির বোঝা নেওয়া যদি আপনার না-পসন্দ হয়, তা হলে বেশি আগ্রাসী না-হয়ে আপনি রক্ষণশীল কৌশলে বিনিয়োগ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে যে-শেয়ার বিশেষ ওঠা-নামা করে না, তাতে টাকা লাগান। আশা করা যায়, পড়তি বাজারেও এগুলি আপনার লগ্নিকে মোটামুটি ভাবে সুরক্ষিত রাখবে। তবে হ্যাঁ, এর থেকে মাঝারি রিটার্নের বেশি কিছু আশা না-করাই ভাল।
উদাহরণ
২০১২ সালের অনেকটা সময় বিশ্ব জুড়ে আর্থিক সঙ্কটের জেরে চূড়ান্ত অস্থির ছিল ভারতের বাজার। অথচ ওই সময়ে ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) শেয়ারগুলির চাহিদা ছিল বেশি। কারণ, সেই অস্থির বাজারে তুলনায় শান্ত থেকে বেশ ভাল রিটার্ন দিয়েছিল ওই সব শেয়ার।
ষোলো আনা সাহসী
এ বার ধরা যাক বেশি ঝুঁকি নিতে আপনার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কিন্তু চড়া রিটার্ন আপনার চাই-ই। সে ক্ষেত্রে বাজি হওয়া উচিত সেই সব শেয়ার, যেগুলির দাম স্বল্প মেয়াদে দ্রুত ওঠা-নামা করে। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে এরাই বিপুল মুনাফার সুযোগ করে দিতে পারে।
খুব ছড়িয়ে লাভ কী?
দু’তিনটি শেয়ারে লগ্নি সীমাবদ্ধ রাখুন। এক সঙ্গে গুচ্ছখানেক শেয়ারে তা না ছড়ানোই ভাল। বড় ও মাঝারি সংস্থার শেয়ার মিলিয়ে-মিশিয়ে কিনুন। তবে লক্ষ রাখবেন, ওই সব সংস্থা যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। নইলে ঠকতে হতে পারে। বিশেষত যাঁদের তহবিল সীমিত, তাঁদের জন্য এই পন্থা বেশ ভাল।
উদাহরণ
ধরুন, গাড়ি সংস্থার শেয়ার কিনতে চান। আমার মতে, ঝুঁকি এড়াতে চাইলে সেরা গাড়ি সংস্থাগুলিরই শেয়ার বাছুন। তাতে হয়তো তার দাম বেশি পড়বে। কিন্তু তেমনই প্রতিষ্ঠিত নামী ব্র্যান্ডে লগ্নি করায় তার দর রাতারাতি তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম। শুধু তা-ই নয়। সেরা সংস্থা মানে গাড়ি বাজারের বেশ বড় অংশ রয়েছে তার দখলে। ফলে আগামী দুই ত্রৈমাসিকে যদি সুদ কমে আর তার দৌলতে গাড়ির চাহিদা বাড়ে, তখন আপনাকে আর পায় কে!
নজর দিন ‘ভিতে’
ইতিমধ্যেই অনেক বিশেষজ্ঞ বলতে শুরু করেছেন, ভারতীয় অর্থনীতির চাঙ্গা হওয়ার লক্ষণ ক্রমশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। আমি বলব, এই পরিস্থিতিতে ইস্পাত, নির্মাণ, পরিকাঠামো, সিমেন্ট, আকরিক লোহার মতো মূল শিল্পে টাকা ঢালা যথেষ্ট বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, সূচক যে-উচ্চতাতেই থাকুক না কেন, সার্বিক ভাবে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়লে প্রথমেই এই সমস্ত ক্ষেত্রে তার সুফল পড়তে বাধ্য। তাই অর্থনীতির ভিতে নজর দিলে ঠকবেন না।
উদাহরণ
২০১১-’১২ সালে ঝিমিয়ে থাকলেও ইতিমধ্যেই ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে ইস্পাত শিল্প। তাই বাছাই করে সেরা ইস্পাত সংস্থাগুলির শেয়ারে লগ্নি করতে পারেন। |
• খুব তেজী শেয়ারে হাত না-দেওয়াই ভাল। স্বাভাবিক গতিতে যারা বাড়ছে, তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিন। তবে ভাল পরামর্শদাতার সঙ্গে কথা না-বলে উঁচু বাজারে ঢোকা বোকামি
অজিত দে, ডিরেক্টর, দেকো সিকিউরিটিজ |
• বাজার যখন চূড়ার কাছাকাছি, তখন ভাল রিটার্নের জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করবেন না। পস্তাতে হতে পারে। বরং কিছুটা উঠলেই শেয়ার বেচে বেরিয়ে আসুন
এস কে কৌশিক, ডিরেক্টর, ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জ |
• আর্থিক ভিত মজবুত, ভাল ব্যবসা করছে, এমন সংস্থার শেয়ারেই টাকা ঢালুন। তবে বাজার অতিরিক্ত তেতে থাকলে, দু-এক মাস একটু দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ
লক্ষ্মণ শ্রীনিবাসন, এমডি, ফিনশোর ম্যানেজমেন্ট |
|
সহজপাঠ ভুলবেন না
চড়া বাজারে বিনিয়োগ করার আগে কী কী শর্ত মাথায় রাখা উচিত, তা নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম আমরা। কিন্তু মনে রাখবেন, বাজারে লগ্নির কিছু চিরন্তন নিয়ম আছে। যেগুলো বিনিয়োগের প্রাথমিক শর্ত। যে কোনও পরিস্থিতিতে, সূচকের যে কোনও উচ্চতায় এই সব নিয়ম প্রযোজ্য। আসুন, সেই সহজপাঠ এক বার মনে করে নেওয়া যাক
• নিজের লগ্নিতে নিয়মিত নজর দিন। সেই সঙ্গে খবর রাখুন সংস্থা ও বাজার সম্পর্কে।
• চট করে লগ্নি-কৌশল বদলাবেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি অনুযায়ী তা অবশ্যই কিছুটা পাল্টে নিতে হবে। কিন্তু তা বলে প্রতি মুহূর্তে বদল আদৌ কোনও কাজের কথা নয়।
• লগ্নির ক্ষেত্রে নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিন।
• কতটা রিটার্ন আশা করেন, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখুন।
• ভেবে দেখুন, ওই রিটার্ন পেতে প্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে কি না।
• কম ঝুঁকি পছন্দ হলে, কম থেকে মাঝারি রিটার্নে খুশি থাকুন।
• লগ্নির টাকা বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধৈর্য ধরুন।
• স্বল্প মেয়াদে যে-সব শেয়ারের দাম খুব বেশি ওঠা-নামা করছে, সেখানে টাকা ঢালার আগে সাবধান। একই পরামর্শ প্রযোজ্য বিভ্রান্তি কিংবা জল্পনা থাকা শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও। এ নিয়ে এর পরেই আরও একটু বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা।
• একই সঙ্গে মনে রাখবেন, যে কোনও শেয়ারের দরই দৈনিক লেনদেনের ভিত্তিতে যেমন উঠবে, তেমনই অল্প-স্বল্প নামবেও।
তা নিয়ে ঘাবড়ানোর কোনও কারণ নেই। শুধু খেয়াল রাখবেন দীর্ঘ মেয়াদে ওই সংস্থার সুনাম, ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ইত্যাদি প্রশ্নের মুখে পড়ছে কি না। এক কথায়, দীর্ঘ মেয়াদের জন্য যে-শেয়ারে লগ্নি করেছেন, স্বল্প মেয়াদে তার ওঠা-নামায় প্রভাবিত হবেন না।
জল্পনার ফাঁদে পা নয়
আলোচনা শেষ করার আগে আর একটা বিষয়ে জোর দিতে চাই। তা হল, নিজের চোখ-কান-বুদ্ধির উপর আস্থা রাখুন। কখনওই জল্পনার ফাঁদে পা দেবেন না। অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শুধু অন্যের কথায় প্রভাবিত হওয়ায় বহু জনকে বড়সড় ক্ষতির মুখে পড়তে দেখেছি। কেউ হয়তো জলের দরে ভাল শেয়ার বেচে দিয়েছেন। আবার কেউ চটজলদি মুনাফার লোভে পকেটে পুরে ফেলেছেন তুলনায় দুর্বল শেয়ার। দু’য়েরই মাসুল গুনতে হয়েছে মোটাসোটা লোকসান করে।
বালাই ষাট! সেই ভুল আপনি করবেন কেন? |
|
|
|
|
|