ফিরছে মাওবাদীরা
সব জানাও, বাইক থেকে
আদেশ শুনেই তটস্থ ভিড়

ঠিক যেন মাটি ফুঁড়ে হাজির হল মোটরবাইকটা। চালক আর পিছনে এক জন আরোহী। পূর্ণাপানি গ্রামে সবে কথা শুরু হয়েছে অঞ্জন মাহাতো, সন্দীপ মাহাতোদের সঙ্গে। চলন্ত মোটরবাইক থেকেই ওঁদের কাছে নির্দেশ এল, “এঁরা সব সাংবাদিক। যা বলার আছে, বলে দাও। যা হচ্ছে, সব জানাও।” কাঁচা রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে বাইকটা চলে গেল দৃষ্টিপথের বাইরে।
গ্রামে পৌঁছনোর পর তখন মিনিট পাঁচেকও হয়নি। গ্রামের শুকনো কুয়োতলার পাশে জড়ো হওয়া গুটিকতক মানুষের সবাইকেও তখন নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় জানানো যায়নি। তার মধ্যেই ওই মোটরবাইক আরোহীরা আগন্তুকদের পরিচয় জেনে গেলেন! অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরিচয় দেওয়ার পরই জটলা থেকে এক যুবক একটু তফাতে সরে গিয়ে মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলে নিয়েছিলেন। তার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঈশান কোণ থেকে ডিগডিগ ডিগডিগ শব্দ করে ওই মোটরবাইকের আবির্ভাব। চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে আসা নির্দেশ পেয়ে যেন তটস্থ হয়ে ওঠেন গ্রামবাসীরা।
কিন্তু নির্দেশ তো এল কিছু গোপন না-করার। কাজেই, গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সব কিছু জানা যাবে, এমন ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং আসলে কী ভীষণ ভুল সেই ধারণা!
লালগড়ের পূর্ব দিকে এই আদিবাসী প্রভাবিত পূর্ণাপানি গ্রাম। হাজার দেড়েক মানুষের বসবাস। মাওবাদীদের, বিশেষ করে কিষেণজি, তেলুগু দীপকের মতো শীর্ষ নেতাদের প্রিয় জায়গা ছিল ভুলাগাড়া-বড়ডাঙা, পূর্ণাপানি, লক্ষ্মণপুরের মতো জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামগুলি। পুলিশের খবর অনুযায়ী, এখনও বিকাশ ও তাঁর স্ত্রীর নেতৃত্বাধীন স্কোয়াডের আনাগোনা রয়েছে ওই এলাকায়। লালগড়ের মানুষ ও যৌথ বাহিনীর বক্তব্য, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পূর্ণাপানি লাগোয়া জঙ্গল থেকে পিলে চমকানো ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এসেছিল। তল্লাশি অভিযান চালিয়েছিল সিআরপি। কিন্তু কাউকেই পাওয়া যায়নি। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মতে, নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে একটি শক্তিশালী ল্যান্ডমাইন ফাটিয়েছিল মাওবাদীরা।
কোন দিকে হয়েছিল বিস্ফোরণ?
“বিস্ফোরণ? কবে, কোথায়?” মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন গ্রামের লোক। তার পর সুব্রত মাহাতো বলেন, “সে বোধ হয় কয়েক বছর আগে হয়ে থাকবে। সম্প্রতি এখানে তো কিছু ঘটেনি। আপনাদের কোথাও বোধহয় ভুল হচ্ছে। এখানে ও সব কোনও ব্যাপার নেই। সব এখন শান্ত।”
কথা চলছে। মোটরসাইকেলের পিছনে থাকা আরোহীর হঠাৎ পুনরাগমন। তবে কোনও কথা নেই। শুধু যেন চোখ বুলিয়ে নিলেন পরিস্থিতির উপর। একটু পর মোটরসাইকেলটা একটু তফাতে চক্কর কাটতে লাগল। আসলে প্রথমেই মোটরবাইক থেকে দেওয়া নির্দেশের অন্তর্নিহিত অর্থ পরিষ্কার বুঝে নিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। যা হচ্ছে, সব বলা যাবে না। যা ঘটছে, সব জানানো যাবে না। তার কারণ একটাই। ভয়। কী রকম ভয়, সেটা জানালেন গ্রামের যুবক সন্দীপ মাহাতো। তাঁর কথায়, “গ্রামের শ’তিনেক যুবকের মধ্যে দু’-এক জন ছাড়া সকলেই আমার মতো বেকার। তা সত্ত্বেও হাতে গোনা কয়েক জন যুবক জুনিয়র কনস্টেবলের চাকরির আবেদন করে। খুব গোপনে। আমরা এই নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম। জানাজানি হয়ে গেলে তো...।”
ভয়টা যাদের থেকে, তাদের নাম এক বারও উচ্চারণ করেন না গ্রামের মানুষ। জটলার মধ্যে থেকে এক জন বলে ওঠেন, “আমরা ঠিক থাকলে মানুষও ঠিক থাকবে, জঙ্গলও ঠিক থাকবে। এটা যেন সবাই মনে রাখে।”
এ তল্লাটের অনেকেই মনে রেখেছে হাতেকলমে কিষেণজির মতো গেরিলা নেতার কাছ থেকে শেখা নানাবিধ বিদ্যে। গ্রামে ঢোকার বিভিন্ন প্রবেশপথের মুখে ‘সেন্ট্রি’ ডিউটি যার অন্যতম। পূর্ণাপানি থেকে লক্ষ্মণপুর গ্রামে যাওয়ার পথে দু’-দু’বার এমন সেন্ট্রির দেখা মিলল। গাড়ি যাতে সঠিক রাস্তা ধরে, সেটা নিশ্চিত করতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। সাংবাদিকদের গন্তব্য কী ভাবে যেন আগাম জেনে যাওয়া ‘সেন্ট্রিরা’ একটি শব্দও উচ্চারণ না-করে শুধু হাত দেখিয়ে রাস্তা চেনালেন লক্ষ্মণপুরের। সেই লক্ষ্মণপুর, ২০০৯-এর ২২ অক্টোবর যে-গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে কিষেণজিকে বন্দুকের একেবারে পাল্লায় পেয়ে গিয়েছিল যৌথবাহিনী। কিন্তু সাঁকরাইল থানার অপহৃত (কিষেণজির ভাষায় ‘যুদ্ধবন্দি’) ওসি অতীন্দ্রনাথ দত্ত তখনও মাওবাদীদের হাতে বন্দি ছিলেন বলে যৌথবাহিনীকে খালি হাতেই ফিরে আসতে হয়েছিল।
সেই পরিস্থিতি এখন অবশ্য নেই।
বেলপাহাড়ির কংগ্রেস নেতা সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “আপাত শান্তি বজায় থাকা আর আতঙ্ক পুরোপুরি কাটা দু’টো এক নয়। না-হলে বেলপাহাড়ি ও আশপাশের এলাকায় অন্তত পাঁচটি রাস্তা পাকা করার জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছে কিন্তু কোনও ঠিকাদার কাজ করতে চাইছেন না কেন? কিছু গোলমাল হচ্ছে না। এক ধরনের নৈঃশব্দ বিরাজ করছে। আর একেই শান্তি বলে দাবি করছেন কেউ কেউ!”
কিন্তু সেই নৈঃশব্দও যে মাঝেমধ্যে ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে সূর্য ডুবতে না-ডুবতেই! ভরসন্ধ্যায় মালাবতীর জঙ্গলের বুক চিরে যাওয়া শিলদা-বিনপুর সড়ক ধরে, কালিয়াম পেরিয়ে কাঁকো গ্রামের দিকে ছুটছিল গাড়ি। হঠাৎই পশ্চিম দিকে জঙ্গল থেকে গুলির শব্দ। তার উৎসস্থল পিচ রাস্তা থেকে খুব দূরেও নয়। যৌথবাহিনীর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির শব্দ সাধারণত এই রকম হয় না। তা হলে?
সেই সময়ে আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) থাকা এবং সদ্য সিভিল ডিফেন্স-এর অধিকর্তা পদে বদলি হওয়া গঙ্গেশ্বর সিংহ বলেন, “গোটা তল্লাট এখনও মাওবাদীদের খাসতালুক। এখনও জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামগুলিতে ওদের আনাগোনা আছে। মনে হয়, ওদের হাতে কিছু নতুন বন্দুক ও গুলি এসেছে। ওরা মালাবতীর জঙ্গলের ভিতর সে সবই পরীক্ষা করছিল।”
শুধু হাতে আসা নতুন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নয়। মাওবাদীরা পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে গতিবিধির ধরন থেকে রাজনৈতিক কৌশল সব কিছু নিয়েই।

(চলবে)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.