পাত্র কেমন, খোঁজ নিয়ে তবেই বিয়ে সীমান্তে
ময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে সীমান্তও।
মেয়ের বিয়ে ঠিক করার আগে পাত্র সম্পর্কে অন্যের উপরে ভরসা না করে নিজেই খোঁজখবর নিয়েছিলেন রানিনগরের ইন্দাদুল সেখ। আর তাতে জানতে পারেন যে, কী এক ব্যবসার কারণে প্রায়ই দিল্লি কিংবা মুম্বইয়ে যাতায়াত করতে হয় হবু জামাইকে।
জানতে পারেন যে, স্কুলের গন্ডি না পেরনো ওই যুবক বহু মেয়েকে বাইরে কাজের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। সাত-পাঁচ বেবে শেষ পর্যন্ত ইন্দাদুল ওই যুবকের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ের কথা আর এগোননি। কেন? ইন্দাদুল বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে যা তথ্য পেয়েছিলাম সেটা খুব সুবিধের বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল ছেলেটি মেয়ে পাচারের সঙ্গে কোনও বাবে যুক্ত। মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, তাকে হারাতে তো চাইনি!’’
অথচ বছর কয়েক আগেও সীমান্ত এলাকার চিত্রটা ছিল অন্যরকম। মেয়ের বিয়ে? তা অত খোঁজ খবর নেওয়ার কী আছে? পাত্র দেখ, খাঁই কম দেখে মেয়ে বিদায় করএই ছিল মোটের উপর মানসিকতা।
দরিদ্র পরিবারে বিয়ে এবং বাইরে কাজ, মূলত এই দুটো টোপ দিয়েই এক সময় রমরমিয়ে তাই চলত নারী পাচার। ডোমকল কিংবা তেহট্টের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে হঠাৎ করে ভিন রাজ্যের পাত্রের আনাগোনাও বেড়ে গিয়েছিল। বেছে বেছে দরিদ্র পরিবারগুলোতে গিয়ে নিখরচায় বিয়ের টোপ দিত ওই যুবক ও তার ‘পরিবারের লোকজন।’ ফলে এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে কেই বা চায়? বিয়ের পর মেয়ের খোঁজ অবশ্য পেতেন না অধিকাংশই। তা নিয়ে ক-জনই বা থানা-পুলিশ করেছেন। মেয়ে তো, বিয়ের পর আর আমাদের দায়িত্ব কী! স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক জানান, “গ্রামবাসীদের অধিকাংশেরই মানসিকতা ছিল, বিয়ে তো দিয়ে দিয়েছি, আমাদের আবার ভাবনা কী?”
এখন অবশ্য ইন্দাদুলরা একা নন, ডোমকল কিংবা তেহট্ট মহকুমার সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলো এখন অনেক বেশি সচেতন। অনেক বেশি সজাগ। তাই শুধু মেয়ের বিয়ে নয়, যে কোনও ব্যাপারেই আগাপাসতলা খোঁজ নিয়ে তার পরেই পদক্ষেপ করেন সীমান্তের মানুষ।
জলঙ্গির হবিবুর রহমানের কথায়, ‘‘এখন দিনকাল পাল্টেছে। ভিন রাজ্য থেকে গ্রামে এসে হিন্দিতে যা বোঝাবে আর গরিব বাবা সে সব না বুঝে সরল বিশ্বাসে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে- সে দিন এখন আর নেই। ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে গ্রামের অনেকেই এখন হিন্দি বলতে পারেন। ফলে বিয়ের নাম করে অন্য কোনও উদ্দেশ্যে গ্রামে এসে এখন আর কেউ সুবিধে করতে পারে না।’’
করিমপুর-১ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ শঙ্কর মণ্ডল যেমন বলেন, ‘‘সীমান্তের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পাচার কিংবা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা। বিশ্বস্ত কাউকে বিশ্বাস করেই ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে কিংবা বিয়ের পর বেমালুম হারিয়ে গিয়েছে অনেক মেয়ে। আসলে তারা যে পাচার হয়ে গিয়েছে সে কথা বুঝতে বুঝতে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। থানা, পুলিশ, প্রশাসন কেউই তেমন কিছু করতে পারেনি। কখনও শেষমেশ মেয়েটিকে হয়ত খুঁজে পাওয়া গিয়েছে কিন্তু বাড়ি ফিরে সেই মেয়েটি আর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারেনি।’’
ডোমকলের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘‘এক সময় সীমান্তের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে প্রায়ই ঘটত নারী পাচারের ঘটনা। অভিযোগ পেয়ে পুলিশকর্মীদেরও সেই পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েটির খোঁজে দৌড়ে বেড়াতে হত বিভিন্ন রাজ্যে। কিন্তু এখন তা অনেকটাই কমেছে।’’ সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কর্তারাও জানাচ্ছেন যে নারী পাচারের ঘটনা এখন অনেক কম। কিন্তু কেন এই বোধোদয়?
বস্তুত গত সাত-আট বছরে রাজ্যের সীমান্ত এলাকার চেহারাটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। সচেতনতার পাশাপাশি আর্থিক ভাবেও স্বচ্ছলতা ফিরেছে এলাকায়। ডোমকল কিংবা করিমপুর সীমান্তে কাজের সুযোগ বাড়েনি, বরং কমেছে। তাহলে জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্যের পুররুদ্ধার হল কী করে? বিভিন্ন স্বেছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা জানাচ্ছেন, এলাকার বহু মানুষ এখন কেরল থেকে গুজরাত। গুরগাঁও থেকে নয়ডা। বিভিন্ন কাজে পাড়ি দিচ্ছেন। এমনকী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতেও। বছরে বার তিনেক তাঁরা বাড়িও ফেরেন। দিন মজুরি থেকে জরির কাজ, আয় মন্দ নয়। স্বাচ্ছন্দ্য ফিরেছে তাঁদের প্রবাসের আয়ে। আয় বাড়ায় বাড়ির বাচ্চারা যাচ্ছে স্কুলে। বাড়িতে এসেছে টিভি। দুনিয়ার খবর তারা দেখছেন। যা পরোক্ষে তাঁদের সচেতনতাও বাড়াচ্ছে বলে দাবি ওই সংগঠনগুলির।
এ ছাড়া স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের ভূমিকাটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছেন গ্রামের মহিলারা। সচেতনতা আসছে সে পথেই। ডোমকলের মহকুমাশাসক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, ‘‘সীমান্তে নারী পাচারের ঘটনা কমে যাওয়ার পিছনে প্রশাসন, পুলিশ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গ্রাম পঞ্চায়েতের পাশাপাশি বিরাট ভূমিকা নিয়েছে স্বনির্ভরগোষ্ঠীর মহিলারা। রোজই ব্যাঙ্ক, বিডিও অফিস বা পঞ্চায়েতে কাজে আসার সুবাদে তাঁরা নিজেরা যেমন সচেতন হয়েছেন তেমনি পাড়াতে গিয়েও অন্যান্যদের সচেতন করেছেন। পাশাপাশি নারী শিক্ষার হারও অনেক বেড়েছে। আর এই সবেরই মিলিত সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে।”
নদিয়ার পুলিশ সুপার সব্যসাচী রমন মিশ্রের ব্যাখ্যা, ‘‘গোটা জেলা জুড়েই নারী পাচারের ঘটনা অনেক কমে গিয়েছে। সীমান্ত এলাকার থানাগুলোর এই ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। নারী পাচারের ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সব সময় সতর্ক রয়েছি আমরা।’’
ঘুম ভাঙা সীমান্তে এখন জাহানারা, সাদিকাদের ‘অচেনা’ মানুষের হাতছানিতে সাড়া দিতে হচ্ছে না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.