কোথা থেকে দুর্গন্ধ আসে? কী ভাবে মশা-মাছি ঘরের আনাচে-কানাচে ভনভন করে? কেন কোনদিন ধীরস্থির ভাবে খেতে পারেন না? কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে পরিদর্শনে যাওয়া বিচারকদের সামনে পেয়ে তা বিশদে জানাতে গিয়ে ক্ষোভে-দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলছিলেন তুলামণি রায়, স্বপ্না রায়দের মতো বাসিন্দারা। মঙ্গলবার শিলিগুড়ি পুর এলাকার ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের ডাম্পিং গ্রাউন্ড ও লাগোয়া এলাকায় দেখা গেল এমনই দৃশ্য।
সেখানে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে গিয়েছিলেন দার্জিলিঙের মুখ্য বিচার বিভাগীয় বিচারক আশরাফুল মোল্লা। ছিলেন শিলিগুড়ি আদালতের অতিরিক্ত দায়রা বিচারক মধুমিতা বসু। উপস্থিত ছিলেন পুর কমিশনার প্রভুদত্ত ডেভিড প্রধান, চিফ ইঞ্জিনিয়ার চিত্তরঞ্জন বর্মন, দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ডের চিফ ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত ঘোষ। |
মঙ্গলবার ডাম্পিং গ্রাউন্ড এলাকা পরিদর্শনে দার্জিলিং-এর
মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারক আশরাফুল মোল্লা।—নিজস্ব চিত্র। |
দার্জিলিঙের মুখ্য বিচার বিভাগীয় বিচারক দীর্ঘ সময় ধরে এলাকা ঘুরে দেখেছেন। তিনি জঞ্জালের স্তূপে উঠেও পরিস্থিতি দেখেছেন। লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের কয়েকজনের সঙ্গে নানা বিষয়ে তথ্যও জেনেছেন তিনি। সেই সময়েই বৈকুণ্ঠপল্লির তুলামণি রায়দের বলতে শোনা গিয়েছে, “স্যার, এ ভাবে এ ভাবে দিনের পর দিন বাঁচা যায়?”
ঘটনাচক্রে, ওই সময়ে তুলামণি দেবীরা কত দিন থেকে সেখানে বসবাস করছেন সেই ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ দেওয়ার দাবি তোলার চেষ্টা করেন পুরসভার এক সমীক্ষক। তিনি বাড়ির নকশা কবেকার তা জানতে চান। তখনই স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিবাদে সরব হন। তাঁরা জানান, ওই এলাকাটি আগে পঞ্চায়েতের আওতায় ছিল। ফলে, সব বাড়ির নকশা নেই। তা ছাড়া, যেখানে শিলিগুড়ি শহরে বিনা নকশায় চানাপট্টিতে চার তলা বাড়ি হচ্ছে, শেঠ শ্রীলাল মার্কেটে গ্যারেজ দখল করে দোকান বানিয়ে বহু কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে, সেখানে নজরদারি না-করে কেন পুরসভার অফিসার-ইঞ্জিনিয়ররা মধ্যবিত্ত ও হতদরিদ্রদের হয়রান করতে ব্যস্ত, সেই প্রশ্ন তোলেন অনেকে। বেগতিক দেখে ওই পুর অফিসার চুপ করে যান।
এর পরে ওই এলাকার বহুতলের বাসিন্দা সুমিত্রা ঘোষ তাঁর ‘ভয়াবহ’ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, “এখানে আসার পর থেকে চুল পড়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের চর্মরোগ হচ্ছে। মশা মাছির উৎপাতে জানালা খোলা যায় না।” জ্যোতিনগরের বাসিন্দা স্বপ্না রায়ও দুঃসহ দূষণের কথা বলতে গিয়ে ভেঙে পড়েন। ডনবস্কো প্রি ইভিনিং হিন্দি হাইস্কুল ও একতিয়াশাল তিলেশ্বরী অধিকারী হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও অনেকে দ্রুত ডাম্পিং গ্রাউন্ড সরানোর আর্জি জানান। কৌশিক রায়, রাজু রায়ের মতো ছাত্ররা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা বলে, “মাঝেমধ্যে খুব মাথা ব্যথা হয়। শরীর খারাপ লাগে। শ্বাসকষ্ট হয়।”
বস্তুত, এ হেন দূষণের অভিযোগ জানিয়ে পুরসভা, প্রশাসনের কাছে আবেদন করে কাজ হয়নি। তাই ওই এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত সচেতনতা জাগরণ কমিটির সম্পাদক সুজিত বিশ্বাস গত বছরের ১১ অগস্ট কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তাঁরা। আট মাস পরে হাইকোর্টের নির্দেশে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে রিপোর্ট জানানোর নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশ অনুযায়ী এদিন দার্জিলিং মুখ্য বিচার বিভাগীয় বিচারক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যাগুলি শোনেন।
এদিন ডাম্পিং গ্রাউন্ডের সীমানা প্রাচীর থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরে থাকা চম্পাসারি রায় এর সঙ্গে কথা বলেন বিচারক। তাঁর অসুবিধে গুলি শোনেন তিনি। ডাম্পিং গ্রাউন্ডের কাছে থাকা একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের দূরত্বও মেপে দেখার নির্দেশ দেন তিনি। আলোচনায় দ্রুত সমাধান সূত্র কী হতে পারে তা জানতে পুর আধিকারিকদের কাছে জানতে চান মুখ্য বিচারক। কিন্তু দ্রুত সমাধান সম্ভব নয়, আপাতত আলোচনার মাধ্যমে অস্থায়ী সমাধান সূত্র মিলতে পারে বলে জানান পুর আধিকারিকেরা। পুরসভার এই মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে মুখ্য বিচারকের সঙ্গে আলোচনার পর আশাবাদী স্থানীয়রা। তাঁরা জানান দ্রুত সমস্যার সমাধান মিলবে।
এই প্রসঙ্গে পুরসভার মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত বলেন, “বর্জ্য থেকে সার তৈরির করার পরিকল্পনা রয়েছে। কোন প্রকল্পের কাজ করতে গেলে একটু সময় লাগবে। রাতারাতি কিছু হবে না।”
তবে পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের নুরুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁরা প্রায় ২০ একর জমি কিনেছিলেন পুঁটিমারি এলাকায়। রাস্তা তৈরির কাজও শুরু করেছিলেন তাঁরা। নরুলবাবু বলেন, “আমাদের সদিচ্ছা ছিল। তবুও রাজনৈতিক কারণে তা করতে পারিনি। এখনকার মেয়র ফুলবাগান, বিদ্যুৎ, সার তৈরির ব্যাপারে নানা কথা বলেছেন। কোনও কাজই তো হয়নি।” |