অনুপ সিংহের ‘ছাত্র ইউনিয়নের চরিত্র সংশোধন করা দরকার তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়’ (৫-৩) রচনাটি সময়োপযোগী। তবে বিষয়টি আরও আলোচনার দাবি রাখে। রাজ্যে বাইশ মাস নতুন সরকার এসেছে। এটাই পরিবর্তন। এর সাফল্য-ব্যর্থতা বিচারের সময় এখনও হয়নি। তবে এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে অনেক সামাজিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা-বিনিময় এবং আলোচনার সুযোগ এসেছে। বাম আমলে এই সুযোগ ছিল না।
প্রশ্ন উঠছে, ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যাবস্থায় রাজনীতি করা উচিত কি না। কলেজে কলেজে সংসদ নির্বাচন ঘিরে যে তাণ্ডব চলছে তাতে বেশির ভাগ মানুষ চাইবেন, শিক্ষার্থী শিক্ষালয়ে যাবেন শিক্ষা গ্রহণ করতে। এখানে রাজনীতির প্রবেশ নিষিদ্ধ করাই যুক্তিযুক্ত। এই মন্তব্যে যদি দেশের নব্বই ভাগ মানুষও সায় দেন তবু বিতর্ক চলবে। কারণ, এটা অতিসরলীকরণ মাত্র।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য আদর্শ নাগরিক তৈরি করা। সেখানে দেশের প্রতি ভালবাসা-দায়িত্ব-কর্তব্য যেমন থাকবে, তেমনই নিজের এবং পরিবারের প্রয়োজন মেটাবার তাগিদও থাকবে। এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা পেলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সফল হয়। তাই শিক্ষার সঙ্গেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগাতে হবে। বয়সের সঙ্গে এই চেতনা পরিণত হবে। রাজনৈতিক চেতনা জাগাবার অর্থ কোনও দলের ঝান্ডা ধরা নয়। এই চিন্তা মাথায় রাখার ক্ষমতা, আমরা রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। সেটা জাতীয় স্তরে যেমন সত্য, তেমনই জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এও সমান সত্য। এই চেতনা জাগাবার আদর্শ মঞ্চ হচ্ছে ইউনিয়ন। ইউনিয়ন শব্দের অর্থ মিলন বা সংযুক্তি। একটা জিজ্ঞাসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হোক, এটা কি শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ হতে পারে না? এতে কি সমাজ-উন্নয়নের রসায়ন নেই?
অনুপবাবু সঠিক জায়গাটা ধরেই মন্তব্য করেছেন। ছাত্র ইউনিয়নের চরিত্র সংশোধন করা দরকার, তাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। বিসর্জন দেওয়ার কথা উঠছে কারণ শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকেই সরে এসেছেন। এরই সুযোগ নিচ্ছে রাজনীতির দাদারা। ছাত্রসমাজ অপরিণত বুদ্ধিসম্পন্ন এবং আবেগপ্রবণ। তাদের সহজেই নতুন মতাদর্শে দীক্ষিত করা যায় এবং ত্যাগের মাধ্যমে বড় কাজ করানো যায়। আবার লোভ দেখিয়ে বিপথগামীও করা যায়। প্রথম ব্যবস্থায় ছাত্রসমাজকে রাজনৈতিক চেতনায় দীক্ষিত করা যায়। রাজনীতি আর দলীয় রাজনীতি এক নয়। একই সংবিধানের আওতায় থেকে দেশে ভিন্ন মতাদর্শের কমবেশি ত্রিশ-চল্লিশটি রাজনৈতিক দল বিরাজ করছে। ছাত্রছাত্রীরা যতই পরিণত হবে, অন্তরে জিজ্ঞাসা জাগবে। ততই তারা সক্রিয় হওয়ার জন্য দলীয় রাজনীতির দিকে ঝুঁকবে। এ দেশে এটাই বাঞ্ছনীয় এবং জরুরি।
প্রশান্ত সান্যাল। কলকাতা-২৯
|
ছাত্রদের রাজনীতি একটি প্রাসঙ্গিক এবং তর্কযোগ্য বিষয়। অনুপ সিংহ এ বিষয়ে তাঁর মতামত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন (৫-৩)। তাঁর বক্তব্য, ‘সমাজ বিষয়ে, ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে যদি জানতে হয়, তবে রাজনীতিকে বাদ দিয়ে সেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হতে পারে না...।’ নথি চর্চার বাইরে এসে যুবসমাজকে স্পর্শ করে দেখুন। বর্তমান ছাত্রসমাজ ভুবনীকরণের নিয়মে ষাট-সত্তর দশকের ছাত্র-মননের থেকে অনেক ভিন্ন। তারা এক দিকে যেমন স্মার্ট, নিজস্ব বিধির উপযুক্ত নির্ণায়ক, অপর দিকে তেমনই কার্যকারণ অনুসারে ইগোসেন্ট্রিক। সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতির কারণ ও প্রেক্ষিত যদি আজকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়, তবে তো তুমুল গোলমাল। সেই সময়কার সমাজচিন্তনের নিখাদ প্যাশন, শূন্য দশকে এসে ফ্যাশনসর্বস্ব উদারীকরণের মোহ বিস্তার করে। কেরিয়ার প্ল্যানের মসৃণ রানওয়ের বাইরে প্রথম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কাছে রাজনীতি কেবল একটি দখিনা বাতাস। প্রশ্ন নিশ্চয়ই থাকবে, কারা তবে পতাকার লাঠি নিয়ে পুলিশকাকুর দিকে তেড়ে যায়? কিংবা কাদের হাতের আঙুল অজান্তেই চেপে ধরে কামারশালায় তৈরি ট্রিগার? তারা নিম্ন বা লঘু মধ্যমেধার কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী। কিংবা উঠতি লাল-নীল-হলুদ-সবুজ রঙের জামা পরা রাজনীতি-দাদার কাছের মানুষ। সমাজ নির্মাণ বা ভারত নির্মাণ বলতে যা উপলব্ধ হয়, সেখানে তাদের কন্ট্রিবিউশন শূন্যের কাছে। পরিসংখ্যান ও তথ্য নির্মাণে তারা উপাদানমাত্র। অনুপবাবু মনে করেন, সমাজের প্রয়োজনে ছাত্রদের ‘রাজনীতির অনুশীলন দরকার’! আমাদের বাড়ির যে ছাত্ররা যান্ত্রিক মূষিক দৌড়ের কারণে পাড়া, এমনকী আত্মীয় পরিজনদেরও সফল ভাবে চিনে উঠতে পারছে না, তাদের কাছে কি সমাজ-প্রেক্ষিতে ‘রাজনীতির অনুশীলন’ চাওয়া বোকামো নয়? |
অনুপ সিংহের সঙ্গে কিছু বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ একমত। ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেই প্রচলিত স্থিতাবস্থার একটা বড় অঙ্গ... কায়েমি স্বার্থের দাপট... টাকার কারবার... অপ্রাসঙ্গিক, অনমনীয় সিলেবাস, অপটু পরিকাঠামো... রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, কর্পোরেট দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ...’। কিন্তু তিনি এই সমূহ সিস্টেমকে প্রশ্ন করার দায়িত্ব দিতে চাইছেন ছাত্রদের। তা হলে, সমাজের আর্নিং এবং পোস্ট-রিপ্রোডাক্টিভ সদস্যদের কর্তব্য কেবল গো-পালনের সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়।
আমার বক্তব্যের এক খণ্ডচিত্র অবশ্য অনুপবাবুর রচনার সঙ্গেই মুদ্রিত। লক্ষ করুন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোকচিত্রটি। ছাত্রমননে রাজনীতি-মাদকতা না-সেঁধিয়ে বরং তাদের কয়েক জনকে এ বিষয়ে উৎসাহী করা যেতে পারে। তারা ভবিষ্যতে রাজনীতিকেই পেশা ও নেশা হিসাবে বেছে রেখেছে। কারণ, এও এক ধরনের শিল্প। পশ্চিমবঙ্গে সমূহ শিল্পকে কনিষ্ঠ করে তুললে চলবে কেন?
কৌশিক গুড়িয়া। কলকাতা-৮৬ |