৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজে জমি নিয়ে সমস্যার কথা মানলেও তাঁর সরকার যে ওই কাজের জন্য জোর করে জমি নেবে না, তা ফের স্পষ্ট করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের একটি প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে সম্প্রসারণের কাজে জমি নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনায় কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে। সেখানে ২১টির মধ্যে ১৬টি মৌজায় সমস্যা মিটে গিয়েছে। বাকি ৫টি মৌজায় জমি সমস্যা রয়েছে। কিন্তু আমরা গুলি চালিয়ে বা বুলডোজার চালিয়ে জমি অধিগ্রহণ করব না। বারাসত ও গাইঘাটার মতো জনবহুল এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। তাই ওদের বলেছি, রাস্তার নকশা (অ্যালাইনমেন্ট) বদল করতে হবে। প্রয়োজনে উড়ালপুল করতে হবে।”
জমির অভাবে জাতীয় সড়কের নকশা বদলের যে প্রস্তাব মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন, তা নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ (এনএইচএআই)-এর একাধিক ইঞ্জিনিয়ারের। তাঁদের বক্তব্য, নকশা বদল হলেও সেই রাস্তা যাবে জমির উপর দিয়েই। সে ক্ষেত্রে জনবসতিকে পাশ কাটিয়ে রাস্তা করতে গেলে কৃষি জমি নিতে হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কোনও ভাবেই সরকারি সাহায্য মিলবে না বলে মনে করছেন সড়ক কর্তৃপক্ষ। এনএইচএআই-এর ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, জাতীয় সড়কের উপর যে উড়ালপুল নেই, তা নয়। কিন্তু চার লেনের সড়কের উপরে ঘনঘন উড়ালপুল কোনও মতেই বাস্তবসম্মত নয়। তাতে খরচ যেমন লাফিয়ে বাড়বে, তেমনই টোল আদায়ের ক্ষেত্রেও প্রকল্পটি আর্থিক ভাবে লাভজনক হবে না। |
ইতিমধ্যেই সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের অধীনে উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলায় বাইপাস তৈরি করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়েছে এনএইচএআই-কে। ওই সংস্থার এক কর্তা বলেন, “প্রয়োজনীয় জমি না মেলায় ডালখোলা শহরকে এড়িয়ে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের একটি বিকল্প রাস্তা তৈরির কাজে হাত দেওয়া হয় ২০০৬-এ। কিন্তু সেখানেও একই সমস্যা মাথা চাড়া দেওয়ায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরে এক ঠিকাদার ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন।” ওই এনএইচএআই কর্তার আক্ষেপ, “উত্তর দিনাজপুরে তিনটি বাইপাস তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। একটা বানাতেই যদি এই হাল হয়, বাকিগুলো আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।”
সরকারি কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, বাম আমলে একাধিক ‘ভূমি রক্ষা কমিটি’ গড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণ রুখে দিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল। এখন তারাই শাসন ক্ষমতায়। কিন্তু রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় কেন্দ্রীয় প্রকল্পেও জমি নিতে নারাজ রাজ্য সরকার। এবং তারই জেরে মাস তিনেক আগে ভূমি দফতরের কর্মীরা জাতীয় সড়ক চওড়া করার জন্য আমডাঙায় জমি মাপজোক করতে গেলে স্থানীয় কিছু বাসিন্দা বিক্ষোভ দেখিয়ে তাঁদের তাড়িয়ে দেয়। ভূমি-ব্যবসা রক্ষা কমিটি নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে ওই বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য ছিল, রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে যাঁদের বাড়ি-দোকান ভাঙা পড়বে, তাঁদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু ওই সব বাড়ি-দোকান তো সরকারি জমিতে? তা হলে? মুখ খোলেননি ভূমি দফতরের অফিসারেরা।
জমি হাতে না পাওয়ার কারণে কেবল কাজই পিছিয়ে যাচ্ছে, তা নয়। প্রকল্পের খরচও উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এনএইচএআই-এর এক কর্তা বলেন, “কেন্দ্রীয় সড়ক মন্ত্রক গোটা প্রকল্পটিকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে দফায় দফায় অর্থ বরাদ্দ করেছে। ২০০৮ সালে এর আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছিল ৪২২৭ কোটি টাকা। কাজ শেষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০১৪। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে প্রকল্প কবে শেষ হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।” জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, টেন্ডার ডেকে একাধিক ঠিকাদার সংস্থাকে নিয়োগ করা হলেও তাদের পুরোপুরি কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে ভবিষ্যতে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়তে হবে এনএইচএআই-কে। এবং সে ক্ষেত্রে কাজ থমকে গেলে খেসারত দিতে হবে রাজ্যবাসীকেই।
এই পরিস্থিতিতেও জমি অধিগ্রহণে সরকার যে কড়া মনোভাব দেখাবে না, তা এ দিন আরও এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “২০১০ সালে একটি সমীক্ষা হয়েছিল। তাতেই দেখা গিয়েছে, সম্প্রসারণের জন্য যে পরিমাণ জমি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে মানুষের অসুবিধা হবে। আমি লক্ষ লক্ষ লোককে উচ্ছেদ করতে পারব না। জোর করে জমি নিতে পারব না।”
এ দিন বিধানসভায় সূর্যবাবুর প্রশ্ন ছিল, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজে জমি অধিগ্রহণ বর্তমানে কোন পর্যায়ে আছে? উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “জাতীয় সড়কের সম্প্রসারণের জন্য ২৩৮০ একরের কিছু বেশি জমির প্রয়োজন। এ পর্যন্ত ৪৬৫.৩১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। জমির সমস্যা মেটাতে গত সেপ্টেম্বরে উত্তর ২৪ পরগনার সাংসদ ও বিধায়কদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। আমরা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে নিশ্চয় সাহায্য করব। কিন্তু মানুষকে গুলি করে জমি অধিগ্রহণ করে নয়।”
৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল দশা নিজেই দেখেছেন মমতা। কয়েক মাস আগে নদিয়া ও মালদহে বিভিন্ন দফতরের সচিবদের নিয়ে বৈঠক করতে তিনি সড়কপথে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কলকাতায় ফিরেই ওই রাস্তার করুণ দশা নিয়ে অভিযোগ করেন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। বলেছিলেন, “তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও এনএইচএআই টাকা দিচ্ছে না। গোটা রাস্তাটা খালবিলে পরিণত হয়েছে!” এ দিনও বিধানসভায় মমতা বলেন, “আমি নিজে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জাতীয় সড়কের দুরবস্থার কথা জানিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সড়ক ও পরিবহণ মন্ত্রকের মন্ত্রীকে ফোন করে বিষয়টি দেখতে বলেন। কিন্তু তার পরেও কিছু হয়নি।”
পরে বিধানসভার বাইরে বিরোধী দলনেতা বলেন, “টানাপোড়েন চলছে। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ হতাশ হয়ে পড়ছেন। জমি অধিগ্রহণের কাজ কত দূর এগিয়েছে, এ দিন তার একটা হিসেব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতে বোঝা গেল, মাত্র এক পঞ্চমাংশ বা তার সামান্য বেশি জমি এ পর্যন্ত অধিগ্রহণ হয়েছে! আমরা বলেছিলাম, পূর্ত দফতর-সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে আলোচনা করুন। আমরাও যা করতে পারি, তা করতে রাজি আছি। যদি আপনি চান।” |