নূতন পৃথিবী হইতে নূতন পোপ গিয়া বসিলেন ভ্যাটিকানের সিংহাসনে। প্রথম বার খ্রিস্টীয় সমাজের শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হইলেন দক্ষিণ গোলার্ধ হইতে, দক্ষিণ আমেরিকার মাটি হইতে, এবং জেসুইট গোষ্ঠী হইতে। সুতরাং পোপ ইয়র্গে মারিয়ো বের্গোগ্লিয়ো বা পোপ ফ্রান্সিস বহু দিক হইতেই ‘নূতন’ পৃথিবীর প্রতিনিধি। দক্ষিণ আমেরিকা জুড়িয়া ইউরোপের এই ‘লাতিন আমেরিকান মুহূর্ত’য় শ্লাঘার বন্যা বহিতেছে, অন্যান্য অ-ইউরোপীয় দেশেও উদ্দীপনা প্রভূত। প্রাক্তন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট-এর স্বেচ্ছাবসর লইবার ঘটনাও যেমন অভূতপূর্ব, নূতন পোপ নির্বাচনও ততটাই। ভ্যাটিকানের এক বিষম সংকটকালের প্রেক্ষিতে পর পর দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে কোনও কার্যকারণ সংযোগ রহিয়াছে কি?
অবশ্যই। গত দশক ধরিয়া সর্বোচ্চ খ্রিস্টীয় প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির অভিযোগে প্রবল জর্জরিত, শিশুযৌনসংসর্গের কুদৃষ্টান্তে কালিমালিপ্ত। বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্রাক্তন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট চূড়ান্ত ব্যর্থ হইয়াছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত মর্যাদা রক্ষা করিতে। একই কারণে ভ্যাটিকানের লক্ষ্য ছিল এমন এক পোপ নির্বাচন যিনি এই দুর্নীতিলিপ্ত বলয়ের বাহিরের লোক, এবং এই দুঃসময়ে ভ্যাটিকানকে সাম্প্রতিক কুৎসার বৃত্ত হইতে উদ্ধার করিয়া নূতন ধারার নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। সুতরাং, আশ্চর্য নহে, এই প্রথম জেসুইট পোপ আসিয়া ভ্যাটিকানের হাল ধরিলেন। পাঁচশত বৎসরের নির্মোহ সক্রিয় ধর্মান্তরকরণ ও বিশুদ্ধিকরণে ব্রতী থাকা সত্ত্বেও, খ্রিস্টীয় দুনিয়ার অর্থ-প্রতিপত্তি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বহু অবদান সত্ত্বেও জেসুইটরা কখনওই শীর্ষ পদটি লাভ করেন নাই। তবে লক্ষণীয়, গত দুই জন পোপ বিশুদ্ধিকরণের লক্ষ্য সামনে রাখিয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে জেসুইটদের ফিরাইয়া আনিয়াছিলেন। আজ সেই ধারারই ফল ফলিতেছে। ভ্যাটিকানের প্রাসাদ-অলিন্দে দুর্নাম ও দুর্নীতির দায় হইতে খ্রিস্টীয় নেতৃসমাজকে মুক্ত করিবার ব্রতের শপথ শোনা যাইতেছে প্রথম জেসুইট যাজকের মুখেই। জেসুইট যাজকের পরিধেয়-র রং কালো, তাই সর্বোচ্চ জেসুইট যাজক ‘ব্ল্যাক পোপ’ নামে খ্যাত। একবিংশ শতকে ‘ব্ল্যাক পোপ’ বসন পালটাইয়া ‘হোয়াইট পোপ’-এর আসনে বসিলেন।
আর্জেন্টিনা ইউরোপের মাটিতে নেতৃস্থান দখল করিল, তাহাও অকারণ নহে। চল্লিশ শতাংশ খ্রিস্টধর্মাবলম্বীর বাসস্থান লাতিন আমেরিকাকে একবিংশ শতকের ক্ষমতা-রাজনীতি অগ্রাহ্য করিতে পারে না। ঠিক যেমন ‘এশীয় দৈত্য’ চিন ও ভারতকে আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে ডাকিয়া লইতে হইতেছে, আর্জেন্টিনাকেও ইউরোপের শ্বেত-খ্রিস্টীয় বিশ্ব আর উপেক্ষা করিতে পারিল না। পোপ ফ্রান্সিস অনেকার্থেই স্থিতাবস্থার অনুরক্ত, ব্যক্তিগত জীবনে সদাচারী হওয়া সত্ত্বেও আর্জেন্টিনার সামরিক একনায়কতন্ত্রের সমর্থনে তাঁহার রাজনৈতিক পরিচয়টি বিতর্কিত: সুতরাং এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে ‘বৈপ্লবিক’ আখ্যা দেওয়া আতিশয্য হইবে। কিন্তু সন্দেহ নাই, ভ্যাটিকানের সিংহদরজা বৃহত্তর বিশ্বের জন্য খুলিবার মুহূর্তটি ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হইয়া থাকিবে। |