ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আবার বিষাইয়া উঠিল। এবং এ জন্য পাকিস্তানই দায়ী থাকিবে। পাক পার্লামেন্ট বৃহস্পতিবার একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাশ করিয়া ভারতীয় সংসদে জেহাদি হামলার ‘নাটের গুরু’ আফজল গুরুর ফাঁসির নিন্দা করিয়াছে, তাহার দেহাবশেষ পরিবারের হাতে তুলিয়া না দিবার জন্য ভারতের সমালোচনা করিয়াছে এবং কাশ্মীর হইতে সেনা প্রত্যাহার, জঙ্গি সন্দেহে ধৃতদের মুক্তি ইত্যাদি দাবি জানাইয়া ‘সংগ্রামরত’ কাশ্মীরিদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করিয়াছে। এমন দিনে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট এই প্রস্তাব পাশ করিল, যে-দিন শ্রীনগরে জেহাদি হামলায় পাঁচজন সিআরপি জওয়ানের হত্যার সংবাদ সমগ্র ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়াছে। ভারত সরকার পাকিস্তানের এই আচরণ ও মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করিয়াছে। ভারতীয় পার্লামেন্টেও জবাবি নিন্দা-প্রস্তাব পাশ হইয়াছে।
পাক প্রস্তাবটির প্রণেতা সে দেশের জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলামের প্রধান মৌলানা ফজলুর রহমান। মৌলানা-মৌলবি-মোল্লারা যে জেহাদিদের সমর্থন করিবে, তাহা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মৌলানাদের হাতে তামুক খাওয়ার বাধ্যবাধকতা কোনও নির্বাচিত সরকারের নাই, বিশেষত যে সরকার আর দুই দিন পরেই ক্ষমতা ছাড়িয়া যাইতেছে। তবু যে পাক পার্লামেন্টের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভারত-বিরোধী এই প্রস্তাবটি সমর্থন করিলেন, তাহাতে বুঝা যায়, পুনর্নির্বাচিত হইয়া আসার জন্যও পাক রাজনীতিকদের এখনও জেহাদি রাজনীতিরই আশ্রয় লইতে হয়। ভাবিতে অবাক লাগে, একটি নির্বাচিত পার্লামেন্ট কেমন করিয়া অন্য একটি দেশের (এ ক্ষেত্রে নিকটতম প্রতিবেশী দেশের) নির্বাচিত পার্লামেন্টে সশস্ত্র হামলায় লিপ্ত জঙ্গির সমর্থনে প্রস্তাব পাশ করিতে পারে! বস্তুত, এই ধরনের প্রস্তাবের পর পাকিস্তানের পার্লামেন্ট তথা নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলির গণতান্ত্রিক বৈধতা লইয়াই সংশয় জাগা স্বাভাবিক। ভারতের বিচারব্যবস্থা লইয়া, ন্যায়বিচারের পদ্ধতি-প্রকরণ লইয়া কাহারও প্রশ্ন থাকিতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রের পীঠস্থান যে নির্বাচিত আইনসভা বা পার্লামেন্ট, তাহাকে সশস্ত্র জঙ্গি হামলার লক্ষ্য করিয়া তোলা যে একটি সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপ এবং কোনও মতেই সমর্থনযোগ্য নয়, তাহা লইয়া সংশয় থাকিবে কেন? পাকিস্তানের শাসক ও বিরোধী দলগুলির সমস্বর আফজল-সমর্থন তাই একটি ধিক্কারযোগ্য কাজ। কোন দিন দেখা যাইবে, মুম্বই হামলার আসামি আজমল কাসভের সমর্থনেও ইসলামাবাদের পার্লামেন্ট প্রস্তাব পাশ করিতেছে।
পাকিস্তানের রাজনীতি, সমাজ, আমলাতন্ত্র ও সামরিক বাহিনী জেহাদি মৌলবাদের সহিত কতটা আপস করিয়া চলিয়াছে, এই ঘটনার মধ্যে হয়তো তাহার একটা আভাস মেলে। যে দেশ নিজে নিয়ত জেহাদি সন্ত্রাসের শিকার, প্রতিদিনই কোথাও-না-কোথাও তালিবানি হামলায় ছিন্নভিন্ন হইতেছে, তাহার রাজনীতিকরাও জামাতপন্থীদের আনা প্রস্তাবের বিরোধিতা করার সাহস ধরেন না। তাই লস্কর-এ-তইবা কিংবা হিজবুল মুজাহিদিনের প্রধানরা পাক সরকারের গোকুলেই বাড়িতে থাকে, পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাহাদের সহিত একই মঞ্চে বক্তৃতা দিতেও দেখা যায়। পাক প্রস্তাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ ভারত পাকিস্তানিদের ভিসা দেওয়ার ঢালাও ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও দুই দেশের হকি দলের টেস্ট ম্যাচ সিরিজ বাতিল ঘোষণা করিয়াছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে শীতলতার পরিচায়ক আরও কিছু ব্যবস্থা হয়তো গৃহীত হইবে। কিন্তু সে জন্য ভারতকে দোষ দেওয়া অযৌক্তিক। ভারতীয় গণতন্ত্রের উপর প্রধানত সামরিক জুন্টা শাসিত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসকদের আঘাত ভারতবাসী বরদাস্ত করিবে না। সংসদে বিজেপি সহ সব দলই তাই পাক পার্লামেন্টের নিন্দা-প্রস্তাবে নিহিত গর্হিত অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছে। এই প্রস্তাব যে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বাহিরের অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ, তাহা উল্লেখ করিয়া পাল্টা সর্বসম্মত প্রস্তাবে এ ধরনের প্ররোচনামূলক কাজ হইতে নিবৃত্ত থাকার পরামর্শও পাকিস্তানকে দেওয়া হইয়াছে। পাক পার্লামেন্টের প্রস্তাব যে জেহাদি জঙ্গিদের প্রতি পাক সরকারের সমর্থনেরই প্রমাণ, সাংসদরা তাহা উল্লেখ করিতে ভুলেন নাই। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বরফ গলার প্রক্রিয়াটি পুনরায় বিলম্বিত হইবে। |