ম্যালেরিয়া পরীক্ষার কিট কে কিনবে, তা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে ঠেলাঠেলি। আর তার জেরেই দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের অধিকাংশ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে রোগীকে রক্ত দেওয়ার আগে ম্যালেরিয়ার জীবাণু পরীক্ষাই হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরে রক্ত-নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্তা থেকে শুরু করে একাধিক ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসকেরা সেই অভিযোগের সত্যতা স্বীকারও করে নিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, কোনও গ্রহীতাকে রক্ত দেওয়ার আগে কতগুলি বাধ্যতামূলক পরীক্ষা করতে হয় ব্লাড ব্যাঙ্কের। তার অন্যতম হল, ম্যালেরিয়া পরীক্ষা। রিপোর্টে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট পাওয়া গেলে সেই রক্ত অন্য কাউকে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো ম্যালেরিয়া-প্রবণ এলাকায় এই পরীক্ষা বাদ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না বলে মত চিকিৎসকদের।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কী হচ্ছে?
স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, ম্যালেরিয়া পরীক্ষার কিট না থাকায় অধিকাংশ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে এই পরীক্ষা হচ্ছে না। তাঁরা জানান, কিট না থাকলে একমাত্র উপায় হল স্লাইডে রক্ত নিয়ে মাইক্রোস্কোপের তলায় পরীক্ষা করা। কিন্তু সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে রোজ এত বেশি রক্তের নমুনা আসে এবং তা পরীক্ষা করার জন্য ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ানের সংখ্যা এতই কম যে, প্রত্যেকটি নমুনা স্লাইডে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা অসম্ভব। অতএব, প্রত্যেকটি রিপোর্টে পরীক্ষা না-করেই ম্যালেরিয়ার জায়গায় ‘প্যারাসাইট নট ফাউন্ড’ বলে লিখে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
যার অর্থ, রক্তের মাধ্যমে যে কোনও মুহূর্তে যে কারও দেহে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশের আশঙ্কা পুরোমাত্রায় থেকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য দফতরের টেকনিক্যাল সেলে রক্ত সংক্রান্ত বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহ-স্বাস্থ্য অধিকর্তা কল্যাণ মুখোপাধায় বলেন, “এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, অধিকাংশ সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করা হচ্ছে না। পরীক্ষা না করেই রিপোর্টে লিখে দেওয়া হচ্ছে ম্যালেরিয়ার কোনও জীবাণু পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিকে আলোচনায় বসার জন্য চিঠি দিয়েছি।”
এখন প্রশ্ন, ম্যালেরিয়া পরীক্ষার জন্য স্লাইড-টেস্ট সম্ভব না হলে কেন এলাইজা কিট বা অ্যান্টিজেন কিট ব্যবহার করে সেই পরীক্ষা হচ্ছে না?
কল্যাণবাবুর উত্তর, “কিট পাঠানোর দায়িত্ব ‘ন্যাশনাল এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থা’ বা ন্যাকো-র। সেখানে অতীতে বহু বার ম্যালেরিয়া কিট চেয়ে চিঠি লেখা হয়েছে। কিন্তু ন্যাকোর কর্তারা নির্লিপ্ত। ম্যালেরিয়া পরীক্ষার কিট অত্যন্ত দামি। কিনতে গেলে বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়ে যাবে। ফলে রাজ্যের পক্ষে তা কেনা সম্ভব নয়। আমরা নিরুপায়।”
আর ন্যাকো-র কী বক্তব্য?
ন্যাকো-র অধিকর্তা (ফিন্যান্স) ধর্মদাস রাও বলেন, “আমরা ম্যালেরিয়া কিট কিনে দেব কেন? কোনও রাজ্যকেই আমরা সেটা দিই না। আমরা শুধু এইচআইভি পরীক্ষার কিট সরবরাহ করি। রাজ্যগুলি নিজেরাই হয় ম্যালেরিয়া কিট কিনে নেয়, না হলে স্লাইডেই পরীক্ষা করে নেয়। পশ্চিমবঙ্গ কোনওটাই করছে না কেন? সেটা তো ওদের সমস্যা।”
ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে বাধ্যতামূলক ম্যালেরিয়া পরীক্ষা হচ্ছে কি না, তা নজরদারির দায়িত্ব রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলেরও। সেখানকার অধিকর্তা চিন্তামণি ঘোষ বলেন, “এক-আধটা ব্লাড ব্যাঙ্কে যে এই গোলমালটা হয় না, তা নয়। আমরা শাস্তিও দিই। কিন্তু বেশি হয় না। হলে সারা পশ্চিমবঙ্গটা ম্যালেরিয়ায় ভরে যেত।’’
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কী দাঁড়িয়েছে?
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের চিকিৎসক শুভাশিস ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের এখানে যত রক্ত আসে, সেগুলির ম্যালেরিয়া পরীক্ষা করা হয় না। এত রক্তের নমুনা একটা-একটা করে মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলে ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট দেখতে গেলে আর অন্য কোনও কাজ হবে না। সরকারের এটা বোঝা উচিত। কেন কিট তারা কিনছে না? আমরা প্রত্যেক রিপোর্টেই আন্দাজে লিখে দিতে বাধ্য হই যে, ম্যালেরিয়ার জীবাণু মেলেনি। ভাগ্যিস ফ্রিজে রাখার ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্যারাসাইট মারা যায়, তাই রক্ষে।” মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা সৌরেন্দ্রনাথ গুছাইত আবার বলেন, “সরকারি নীতি নিয়ে তো আর আমরা মুখ খুলতে পারি না। তবে এটুকু বলব যে, রক্ত নেওয়ার আগে মৌখিক ভাবে দাতাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তাঁর জ্বর রয়েছে কি না বা সম্প্রতি ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি হয়েছিল কি না। সেটুকুই আমাদের ভরসা।”
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রধান মধুসূদন মণ্ডল আবার আক্ষেপ করে জানান, স্লাইডে পরীক্ষা করলে রিপোর্ট ভুল বেরোনোর আশঙ্কা থেকেই যায়। সেই কারণে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এক বার ম্যালেরিয়া কিট কেনার জন্য দু’কোটি টাকার প্রকল্পও করেছিল। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। তাঁর কথায়, “আমাদের হাসপাতালে আসা ৫০ শতাংশ রক্তের ম্যালেরিয়া পরীক্ষা আমরা সময় ও লোকাভাবে করতে পারি না।” |