অমিত মিত্রের পেশ করা বাজেটকে ‘বিভ্রান্তিকর এবং অগ্রাধিকার বহির্ভূত খরচের বাজেট’ আখ্যা দিলেন রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। মঙ্গলবার আলিমুদ্দিনে বসে ওই বাজেট সম্পর্কে একের পর এক প্রশ্ন তুলে তাঁর মন্তব্য, এই সব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত বিভ্রান্তি থেকেই যাবে।
অমিতবাবু অবশ্য এ দিন অসীমবাবুর কোনও প্রশ্নেরই জবাব দেননি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “বাজেটেই সব বলা আছে। বাজেটের বইটা পড়লে স্পষ্ট করেই সব বোঝা যাবে। বিধানসভায় বাজেট বিতর্কের জবাবি বক্তৃতায় বাকি যা বলার বলব।” মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ দিন ফেসবুকে তাঁর লেখায় অসীমবাবুর তোলা প্রশ্নের কোনও জবাব দেননি। অমিতবাবুর ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি লিখেছেন, কঠিন আর্থিক পরিস্থিতিতে একটা অসাধারণ বাজেট উপহার দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মমতার কথায়, “রাজ্যের আর্থিক হাল ফেরানোর লক্ষ্যে আমাদের ঐকান্তিক এবং কঠোর পরিশ্রমের ফল ফলতে শুরু করেছে।”
কোন কোন ক্ষেত্রে অমিতবাবুর বিরুদ্ধে এ দিন আক্রমণ শানিয়েছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী?
প্রথম আক্রমণ, রাজস্ব আদায়ে ‘ঐতিহাসিক’ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির দাবিকে কেন্দ্র করে। অসীমবাবুর যুক্তি, রাজ্যের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির মূল দু’টি স্তম্ভই হল যুক্তমূল্য কর এবং বিক্রয় কর। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পণ্য প্রবেশ কর। যা থেকে আদায় হয়েছে ১২৫০ কোটি টাকা। ওই টাকা বাদ দিলে দেখা যাচ্ছে, যুক্তমূল্য কর এবং বিক্রয় কর আদায় বেড়েছে ১৮.৫ শতাংশ। যা বাম আমলের তুলনায় কম বলেই অসীমবাবুর দাবি।
অমিতবাবু এ দিন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব না-দিলেও অর্থ দফতরের একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, “যে সব অফিসার, যে সব ইউনিট এবং যে ইকনোমেট্রিক্স কাজে লাগিয়ে অসীমবাবু বাজেট করতেন, অমিতবাবুও তা-ই করেছেন! অসীমবাবুর লক্ষ্য ছিল ঘাটতিশূন্য বাজেট। আর অমিতবাবুর লক্ষ্য রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধি দেখানো।” আর তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, অসীমবাবু তাঁর শেষ বাজেটে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৪০% রেখেছিলেন। নতুন রাজ্য সরকার ক্ষমতায় এসে সমালোচনা করে বলেছিল, ওই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবোচিত নয়। অমিতবাবু তাই তাঁর প্রথম বছরে ৩০%, পরের বছরে ২৫% এবং আগামী বছর ২২.৭% রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রেখেছেন। |
অসীমবাবুর দ্বিতীয় অভিযোগ, এক শতাংশ হারে প্রবেশ কর চাপানোর ফলে এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। তার সঙ্গে এ বছর বাজেটে প্রায় সব স্তরে যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয়েছে। যা মূল্যবৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগাবে। রাজ্যে যখন শিল্প আসছে না, এবং গোটা বিশ্বে মন্দা চলছে, তখন যুক্তমূল্য কর বাড়িয়ে ও
প্রবেশ কর বসিয়ে শিল্পের কাঁচামালের দামবৃদ্ধির কোনও যুক্তি নেই বলেই তাঁর মত। প্রবেশ কর নেওয়ার ব্যাপারে সংবিধানের ৩০৪ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল কিনা, সেই প্রশ্নও তুলেছেন অসীমবাবু।
অমিতবাবুর বাজেট ঘিরে তাদের অসন্তোষের কথা সোমবারই জানিয়েছে শিল্পমহল। তাদের মতে, শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হতে পারে, এমন কিছু এই বাজেটে নেই। বাজেট বিবৃতিতে অমিতবাবু জানিয়েছিলেন, দেশের জাতীয় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির (জিডিপি) হার যেখানে ৪.৯৬ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে বলে জানানো হচ্ছে, সেখানে রাজ্যে ওই বৃদ্ধির হার হাবে ৭.৬ শতাংশ (আগাম হিসাব অনুযায়ী)। এর মধ্যে শিল্পে বৃদ্ধির হার হবে ৬.২৪ শতাংশ এবং কৃষিতে ২.৫৬ শতাংশ।
উৎপাদন বৃদ্ধির এই অঙ্কের সমালোচনা করতে গিয়ে অসীমবাবুর বক্তব্য, রাজ্যের বৃদ্ধির হার কী ভাবে ওই অঙ্কে পৌঁছবে ,তার পক্ষে জোরালো যুক্তি বাজেটে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁর মতে, কৃষি ও শিল্পের মতো ক্ষেত্রগুলির উপর ভিত্তি করেই রাজ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অনুমান করা সম্ভব হয়। কিন্তু এ রাজ্যে সংগঠিত শিল্পের সংখ্যা কমছে। গত তিন বছরে রাজ্যে শিল্প বিনিয়োগ কমেছে। নতুন কল-কারখানাও বিশেষ হচ্ছে না। অসংগঠিত শিল্পেরও পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি, কৃষি নিয়েও সব তথ্য বাজেটে জানানো হয়নি। এই অবস্থায় রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ওই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনো সম্ভব কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন অসীমবাবু ।
রাজ্য সরকারের আর্থিক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১০-’১১ অর্থবর্ষে রাজ্যে নতুন কারখানা হয়েছিল ৩২২টি, বিনিয়োগ হয়েছিল ১৫,০৫২ কোটি টাকা। সেখানে ২০১২-’১৩ অর্থবর্ষে নতুন কারখানা হয়েছে ১২টি। আর বিনিয়োগ কমে গিয়ে হয়েছে ৩১২ কোটি টাকা। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর প্রশ্ন, শিল্পের সার্বিক চিত্রটাই যেখানে এই রকম, সেখানে বাজেটে কী করে দাবি করা হচ্ছে যে, চলতি অর্থবর্ষে ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে! কী করেই বা আগামী অর্থবর্ষে সেই সংখ্যাটা ১৩ লক্ষ ছাপিয়ে যাবে!
অসীমবাবু বলেন, পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সালে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের সরকারি চাকরি আগের বছরের তুলনায় কমেছে যথাক্রমে ১ হাজার ও ৫ হাজার। বেসরকারি ক্ষেত্রে নতুন চাকরি হয়েছে ৮ হাজার। বিভিন্ন পরিষেবা ক্ষেত্রে ৫ হাজার। স্বনিযুক্তি প্রকল্পে ১ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে। তা হলে কী করে ১০ লক্ষ কর্মসংস্থানের হিসেব দেওয়া হচ্ছে? প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর দাবি, এর কোনও পরিষ্কার চিত্র বাজেটে উল্লেখ নেই।
অসীমবাবু আরও বলেন, সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, কয়লার উৎপাদন কমেছে। অথচ বাজেটে সেস বাবদ আয় ৫৫% বাড়ানো হয়েছে। এর ব্যাখ্যা কী? বিভিন্ন দফতরের ব্যয় বরাদ্দ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। খরচের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঠিকমতো বাছাই করা হয়নি বলেই তাঁর অভিযোগ। উদাহরণ দিয়ে অসীমবাবু বলেন, ৫০ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের। অথচ পূর্ত-সড়ক, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিল্প, সেচ, নারী কল্যাণ প্রভৃতি দফতরের জন্য বাজেট বরাদ্দ এতটা বাড়ানো হয়নি। অসীমবাবুর ইঙ্গিত, অপ্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু অবহেলার শিকার গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলি। রাজ্য বাজেটে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের দাবি নিয়েও এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন অসীমবাবু। তিনি বলেন রাজ্যে মৃত্যুর হার হাজারে ৬ থেকে বেড়ে ৬.২ হয়েছে। শিশু মৃত্যুর হারও হাজারে ৩১ থেকে বেড়ে ৩২। কেন্দ্রীয় অনুদানের তিন ভাগের দু’ভাগ মাত্র খরচ করতে পারল রাজ্য। এর জন্য দায়ী কেন্দ্র না রাজ্য? |