প্রত্যেকটা তাৎপর্যপূর্ণ ফ্রেম! আর পাঁচটা দিন হলে ক্রিকেট সাংবাদিকের হুড়মুড়িয়ে কাটাছেঁড়া করার চিত্রনাট্য।
• কোনও এক সহবাগ অনেক দিন বাদে আর নেই বলে বিরাট কোহলিকে ফার্স্ট স্লিপ ক্যাচিং অভ্যেস করানো চলছে।
• দেশের মাঠে তাঁর জীবনের শেষ টেস্টের আগেরটাতেও পুরনো অভ্যেসে অনড় সচিন তেন্ডুলকর। সংগঠকদের ডেকে দেখাচ্ছেন সাইটস্ক্রিন উঁচু করে ঠিক কোথায় লোক বসানো বন্ধ করতে হবে।
• অনুশীলনের মধ্যেই চেয়ারে গা এলিয়ে পরিতৃপ্তির চায়ে চুমুক ভারত অধিনায়কের! ধোনির সহাস্য মুখটাই যেন সিরিজের প্রতিবিম্ব২-০ এগিয়ে আছি।
• অশ্বিন ল্যাপ দিচ্ছেন এলিভেশন ট্রেনিং মাস্ক পরে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক ওপরে যা সহ্যক্ষমতা ধরে রাখে। অপারেশন দক্ষিণ আফ্রিকা?
• হরভজন পিচ প্রস্তুতকারকের কাছে অনুনয়ের শরীরী ভাষা সমেত দাঁড়িয়ে। রঞ্জি ম্যাচে মনোমত উইকেট চেয়ে কয়েক মাস আগে যেমন পাননি, এ বার তা ঘটলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
অথচ এ সব ইঙ্গিতবহ এক-একটা দৃশ্যে আজ আর কারও কোনও আসক্তি নেই। তেন্ডুলকর ক্রিকেটজীবনের গোধূলি বেলায় আউটফিল্ডে ষোলো বছর বয়সির মতো দৌড়ে ক্যাচ লুফছেনএমন রোমাঞ্চকর দৃশ্য পিছনে ফেলে ভারতীয় মিডিয়ার অন্তর্ধান ঘটল প্রেসবক্সে। লেখা শুরু করতে হবে তো। গড়পড়তা দিন-টিন হলে সচিনকে নীচে রেখে কেউ চারতলায় উঠে যায় না। নেটে চেতেশ্বর পূজারার হাঁটুতে হঠাৎ করে বল লাগার পর ভবিতব্য কী হল? তাঁকে এমআরআই করাতে নিয়ে যাওয়া হল কি না তাতেও যেন কোনও উৎসাহ নেই। |
ভারতের মাটিতেও যখন ক্লার্কের ‘ছায়ায়’ সচিন। মঙ্গলবারের মোহালি। |
আসলে ১২ মার্চ, ২০১৩ লিপ ইয়ারে ফেব্রুয়ারির অতিরিক্ত দিন আসার চেয়েও ব্যতিক্রমী তারিখ। যেখানে সম্পূর্ণ মনোযোগ মহাবিতর্ক আছন্ন অস্ট্রেলিয়ার ওপর। যেখানে তেন্ডুলকরের উপস্থিতিও গত চব্বিশ বছরের রুটিন ভেঙে বাড়তি কোনও মর্যাদা যোগ করতে অসমর্থ।
মোহালি স্টেডিয়াম থেকে ষোলো-সতেরো কিলোমিটার দূরে চণ্ডীগড় ম্যারিয়ট হোটেল। মাইকেল ক্লার্কদের আস্তানা। আর সেক্টর থার্টি ফাইভের নতুন পাঁচতারা হোটেলে ঢুকতে গিয়ে মনে হল সত্যিই যত কাণ্ড এখানে! মোহালি নিছক রেকর্ড বইতে থাকবে।
লবিতে হাসিমুখে ঘুরছেন। বাচ্চাদের অটোগ্রাফ দিচ্ছেন দীর্ঘকায় অস্ট্রেলীয়। যাঁর মতো দেখতে মনে হচ্ছে, তাঁর হাসিমুখ থাকার প্রশ্ন নেই। সুতরাং অন্য কেউ। সিডনির প্রখ্যাত অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক পিটার ল্যালর-কে জিজ্ঞেস করে অবশ্য নিঃসন্দেহ হওয়া গেল যাঁকে ভাবা গেছিল। তিনিই। গ্যাং অব ফোর-এর এক তারকা-মুখ মিচেল জনসন। শীত নেমে এলে আর বসন্তই বা কত দূরে থাকবে?
কিছু পরেই আবির্ভূত হলেন জেমস প্যাটিনসন। তাঁকে এখন স্বাভাবিক দেখাচ্ছে সেটা অবশ্য নতুন ঘটনা নয়। সকালে ট্রেনিংয়ে স্বাভাবিক ছিলেন। প্রেস কনফারেন্সেও নতজানু মেজাজে বলেছেন, আমার জীবনের একটা বড় শিক্ষা হল।
চণ্ডীগড়ের হোটেলে দশ মিনিটের ব্যবধানে দুই বিদ্রোহীকে দেখলে এ দিনের সারমর্ম বুঝতে কারও অসুবিধে হবে না।
বিছিন্নতাবাদীদের কড়া হাতে দমন করল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া! ক্রিকেট সাম্রাজ্য গতকালই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছিল। আজ যেন কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিয়ামক সংস্থার কর্তৃত্ব ফের ঘোষিত হল!
নইলে ভাবাই যায় না টিমে মাত্র বারো জন ক্রিকেটার নিয়ে অস্ট্রেলিয়া এত বড় টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামছে! আগামী কালের প্র্যাকটিসে ধরা যাক, পূজারার মতোই কারও লেগে গেল। তা হলে তো ক্লার্কের টিমে টুয়েলফথ ম্যান বলে কাউকে রাখা যাবে না। কারণ সাসপেন্ড করা চতুষ্টয়ের সঙ্গে যে অন্তত মোহালি টেস্টে কোনও রকম সমঝোতাই নয়, সেটা অস্ট্রেলীয় টিম ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি ভাবে বলা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বড় লাভের জন্য সাময়িক বড় ক্ষতি সহ্য করতে হয়। |
শৃঙ্খলারক্ষায় এত কড়া হতে পারাটা আধুনিক কালের ক্রিকেটে চমকপ্রদ তো নিশ্চয়ই! তাজ্জবও। মোহালি ভারতের একমাত্র সারফেস যা সিরিজে বরাবর অস্ট্রেলিয়ার সেরা সুযোগ ছিল। এখনও আছে। অথচ সেখানে খেলানোর মতো সিমার মাত্র দু’জনপিটার সিডল আর মিচেল স্টার্ক। ধোনির কপালকথাটা কি আর এমনি এমনি প্রবাদসদৃশ হচ্ছে!
অস্ট্রেলীয় শিবির সূত্রে জানা গেল ব্যাগি গ্রিনের মর্যাদা ও টিম শৃঙ্খলারক্ষার ব্যাপারে এমন অনমনীয় সিদ্ধান্ত মোটেও কোচ মিকি আর্থারের নয়। বহির্বিশ্ব যতই তা মনে করুক, আর্থার যথেষ্ট আপসপন্থী। দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ থাকাকালীন হার্শেল গিবস, ডেল স্টেইনদের যে মনোভাব তিনি বরদাস্ত করেছেন, তা তুলনায় অনেক জঙ্গি। এটা পুরোদস্তুর ক্লার্কের আদর্শ। আর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া থেকে লাইসেন্স নিয়েই কার্যকর করা আদর্শ যে টিম সবার আগে। অস্ট্রেলিয়ান টিমের সেই দলগত সংস্কৃতি ফেরত আনতে হবে। যা রিকি পন্টিং আমদানি করেছিলেন। সেই থিম হল: তুমি মহাতারকা হতে পারো কিন্তু যদি মনে করো সবচেয়ে জুনিয়র ক্রিকেটারের এখুনি একটু কফি খেলে ভাল হয়, তা হলে দ্বিধা না করে সেই কফিটা নিয়ে আসবে।
ক্লার্ক এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া চাইছে টিম মনোভাব ফেরত আনতে। সামনে অ্যাসেজ আসছে! বিদেশ-দেশ মিলে দশটা টেস্ট। তার আগে টিমের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি ঠিক করে নিতে হবে। ভারত সফর যত গুরুত্বেরই হোক। অ্যাসেজ যদি আই লিগ হয় ভারত সফর হল অধুনা আইএফএ শিল্ড।
কানাঘুষো শুনলাম ব্যাগি গ্রিনের মর্যাদারক্ষায় চিরতৎপর ক্লার্কও কিন্তু এ দিন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার বড়কর্তা প্যাট হাওয়ার্ডের মন্তব্যে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন। হাওয়ার্ড তীব্র কটাক্ষে বলেছেন, “শেন ওয়াটসন কখনও কখনও টিমের জন্য খেলে।” যা শুনে ব্যথিত ওয়াটসন পাল্টা দিয়েছেন, “হাওয়ার্ড আমায় কতটুকু চেনেন? উনি তো আসলে রাগবি দুনিয়ার লোক।”
হাওয়ার্ড পদমর্যাদায় অস্ট্রেলীয় বোর্ডে দু’নম্বর। জেমস সাদারল্যান্ডের পরেই। হাওয়ার্ডের আগ্রাসী মনোভাব অনেকেরই পছন্দ নয়। কিন্তু তাঁদের কিছু করার নেই। তিনিই ন্যাশনাল পারফরম্যান্স ম্যানেজার। গোটা দেশে ক্রিকেটের দায়িত্বে। গ্রেগ চ্যাপেল থেকে মিকি আর্থারসবাইকে রিপোর্ট করতে হয় তাঁর কাছে। তাই আমাদের টিমে ক্যাপ্টেন-ভাইস ক্যাপ্টেনের মধ্যে বোঝাপড়ার সমস্যা রয়েছে এমন বিস্ফোরক মন্তব্য তিনি করার পরেও আক্রমণ করার মতো সাহসী কারও খোঁজ নেই।
হাওয়ার্ডদের গত এক বছরের পর্যবেক্ষণ এবং অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের বেশ কিছু দিনের অভিজ্ঞতা একটা জায়গায় গিয়ে মিলছে যে, জেনারেশন ওয়াই অজি ক্রিকেটারের ব্যাগি গ্রিনের প্রতি কোনও মমত্ববোধ নেই। দেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য যে অফুরান লড়াইয়ের খিদে আর নিজেকে প্রতিনিয়ত ভাল করার সংকল্প চাই, সেটা তারা দেখাতেই রাজি নয়। বরঞ্চ টি-টোয়েন্টি খেলতে চায় বিশ্ব জুড়ে। যেখানে পরিশ্রম অনেক কম। টাকা বেশি। কার হয়ে খেলে টাকা পাওয়া যাচ্ছে তা নিয়েও তাদের কোনও ব্যাকুলতা নেই। যে বেশি টাকা দিচ্ছে, আমি তার নাগরিক। না-ই বা হল সেটা আমার নিজের দেশ।
প্রথিতযশা অস্ট্রেলিয়ান লিখিয়ে বলছিলেন, “রামচন্দ্র গুহ-র লেখা বই থেকে গাঁধীজির একটা উদ্ধৃতি ব্যবহার করব আজ। যেখানে গাঁধী বলেছেন ভ্রমাত্মক বাণিজ্যীকরণে একটা ছোট দ্বীপ (গ্রেট ব্রিটেন) পৃথিবীর কী ক্ষতিই না করেছিল। ভারতের মতো আকারে বৃহৎ দেশ যদি কোনও দিন সেই ভ্রমাত্মক পথে যায় তা হলে বাকি পৃথিবীর যে ক্ষতি হবে তা অপূরণীয়।” বোঝা গেল তিনি বিশ্বক্রিকেটে ভারতীয় ক্রিকেট বণিকের ইতিমধ্যে আমদানি করা ক্ষতি নিয়ে অজি পাঠককে অবহিত করবেন। যে বৃহত্তর ক্ষতির নাম আইপিএল!
সব দেখেশুনে মনে হবে টেস্ট ম্যাচ যেটা বৃহস্পতিবার মোহালিতে শুরু হবে, সেটা নিছক স্ট্যাম্প সাইজের ব্যাপার। বড় ফার্স্ট ডে কভার হল ঐতিহাসিক এই ধর্মযুদ্ধ। কে জিতবে? ব্যাগি গ্রিন না মানি গ্রিন?
|