নির্বাচন, অর্থাত্ পঞ্চায়েত নির্বাচন এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পাখির চোখ’। ইহা ভিন্ন আর কিছু তিনি দেখিবেন না ঠিক করিয়াছেন, নিকট দূর ভাল মন্দ, কিছুই না। উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ নীতি চালু করিবার সিদ্ধান্ত তাঁহার সেই একাগ্রচিত্ত পঞ্চায়েত-দর্শনেরই ফল। সম্প্রতি ঘোষিত হইয়াছে, বর্তমান ব্যবস্থার উপর আরও ১৭ শতাংশ আসন কলেজগুলিতে সংরক্ষিত থাকিবে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য। এ রাজ্যের প্রেক্ষিতে ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি’ বলিতে মুসলিম সম্প্রদায়কেই বুঝায়, সুতরাং ঘোষণার স্থান-কাল-পাত্র সবই চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দেয় মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবিতেছেন, কেন ভাবিতেছেন। অবশ্যই তিনি একা এই পথের যাত্রী নহেন। সংরক্ষণ ও রাজনীতির অচ্ছেদ্য লীলাবন্ধন ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গের বহু-পরিচিত, বহু-পরীক্ষিত। সুতরাং এই নূতন ঘোষণাটিকে কোনও মতেই ব্যতিক্রমী বলা যাইবে না। বরং তৃণমূল নেত্রীর এই ঘোষণা বড়ই গতানুগতিক, বড় বেশি ঐতিহ্যবাহী, ইহা এবং অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি প্রত্যহ প্রমাণ করিতেছেন যে তিনি তাঁহার পূর্বসূরিদের ধ্বজা বহন করিতেছেন মাত্র, তাঁহার রাজনীতিতে বা সমাজদর্শনে বিন্দুমাত্র নূতনত্ব নাই।
রাজনীতির ঐতিহ্যপথ বাহিয়া রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তবে সংরক্ষিত আসনের হিসাব দাঁড়াইল, ২২ শতাংশ তফশিলি জাতি, ৬ শতাংশ তফশিলি উপজাতি এবং ১৭ শতাংশ অনগ্রসর শ্রেণি: সব মিলাইয়া ৪৫ শতাংশ। অর্থাত্ বিদ্যাশিক্ষার জন্য মেধা ও কৃতিত্বের যাহা কিছু প্রতিযোগিতা, উত্কর্ষসাধনা, সকলই বাকি ৫৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সংরক্ষণের নীতির পশ্চাতে একটি গুরুতর সমাজদর্শন আছে, তাহা অনস্বীকার্য। এবং তাহা স্বীকার করিয়া চলিলে এই দুর্ভাগ্যজনক সীমাবদ্ধতাও স্বীকার করিয়া লওয়া ছাড়া গতি নাই। ইহা সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠার দাম। কিন্তু এই দাম দিবার সঙ্গে আরও একটি কাজ বাকি থাকে দামটিকে কমাইবার চেষ্টা, কিছু অতিরিক্ত প্রাতিষ্ঠানিক রীতিপদ্ধতির ভাবনা। কী প্রকারে সত্যই সংরক্ষণের মাধ্যমে ক্রমশ পশ্চাত্পর জাতি ও শ্রেণিগুলিকে টানিয়া তুলিয়া আদর্শ মানে পৌঁছাইয়া দেওয়া যায়, সে কথা ভাবা। এই ভাবনা ভারতীয় নেতৃত্বের মধ্যে অতি বিরল, এ রাজ্যের গত তিন দশকের বাম নেতৃত্বের মধ্যে তো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত! তিন দশকে রাজ্যের শিক্ষামানের যে নিবিড় ক্ষতি হইয়াছিল, সংরক্ষণনীতির ঢালাও ব্যবহার এবং পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্তগুলি না লওয়া সেই ক্ষতির অন্যতম কারণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে কিন্তু এখনও সময় আছে, গতানুগতিক ক্ষতিসাধনের পথ ছাড়িয়া ভিন্ন পথে চলিবার কথা তিনি ভাবিয়া দেখিতে পারেন।
প্রথম পদ্ধতি: সংরক্ষণ হউক, কিন্তু সঙ্গে অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ব্যবহারও হউক। তফশিলি বা অনগ্রসর সমাজের কেবল অর্থনৈতিক ভাবে অসচ্ছল প্রার্থীকেই এই সুবিধা দেওয়া হউক। নতুবা এই ফোকর দিয়া হু হু করিয়া দুর্নীতির বান ঢুকিতে থাকে। দ্বিতীয় পদ্ধতি: সংরক্ষণ হউক, কিন্তু উচ্চশিক্ষায় মেধার ভূমিকা স্বীকার করিয়া তবেই আসন সংরক্ষিত হউক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তির সময় সংরক্ষিত আসনের জন্য ধার্য নম্বর যেন সাধারণ ভাবে ধার্য নম্বর হইতে দূরবর্তী না হয়, এবং তাহা যেন আবশ্যিক ভাবে মানিয়া চলা হয়। স্নাতক স্তরে প্রবেশের জন্য পূর্ববর্তী পরীক্ষায় যদি ৪০ শতাংশ ‘কাট-অফ’ নম্বর হয়, তবে কোনও অবস্থাতেই যেন তাহা কমানো না হয়। যথেষ্ট সংখ্যক যোগ্য আবেদন-পত্র না মিলিলে সেই দুর্ভাগ্য মানিয়া লইতে হইবে, কিন্তু কেবল সংরক্ষিত আসনের দোহাই দিয়া মেধাসীমা আরও কমানো যাইবে না। অপূর্ণ আসন কি অপূর্ণই থাকিবে, না কি সাধারণ আসনের জন্য খুলিয়া দেওয়া হইবে, তাহা স্থির করুক প্রতিষ্ঠানই। কিন্তু ন্যূনতম যোগ্যতার এই শর্ত দৃঢ় ভাবে মান্য করিবার বিষয়টি নিশ্চিত করুক রাজ্য প্রশাসন। নতুবা পশ্চাত্পর সমাজ কিছুতেই উচ্চতর যোগ্যতামানে পৌঁছাইবার জরুরি প্রয়োজনটি অনুভব করিবে না। বৃহত্তর শিক্ষাব্যবস্থারও ভূয়সী ক্ষতি অব্যাহত থাকিবে। সংরক্ষণ নামক সংস্কারটিকে একমাত্র যথার্থ ভাবে ব্যবহার করিলেই সুফল মিলিবার সম্ভাবনা। সংরক্ষণের বিবেচনাহীন ব্যবহার কিন্তু ক্ষতিই বাড়াইয়া চলে। |