বিনোদন
শেষ ক্যানভাসেও ভিড় এড়ালেন গণেশ পাইন
তাঁর ছবির মধ্যে জীবনানন্দের কবিতাধর্মী এক ধরনের অন্তর্মুখিতা খুঁজে পান অনেক গুণমুগ্ধই। ব্যক্তিগত জীবনেও গণেশ পাইন একা-একা হাঁটতে ভালবাসতেন। ভিড় এড়িয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানের নেমন্তন্নে যেতেন এক দিন আগে বা পরে। মঙ্গলবার দুপুরে প্রয়াত চিত্রশিল্পীর শেষযাত্রাও প্রধানত ব্যক্তিগত পরিসরে, তাঁর প্রিয়জনেদের মধ্যে নিচু তারেই বাঁধা থাকল।
গত বছরের পুজো থেকে মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে বাঙালির তিনটি ইন্দ্রপতন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রবিশঙ্করের পরে গণেশ পাইন। এ দিন দুপুরে পঞ্চসায়রে ইস্টার্ন বাইপাস সংলগ্ন একটি হাসপাতালে প্রয়াত হন গণেশ। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। গত ডিসেম্বরে রবিশঙ্কর মারা যান সূদূর সান দিয়েগোয়। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক
অষ্টমীর রাতে সুনীলের প্রয়াণের দু’দিন বাদে তাঁর পুত্র প্রবাস থেকে কলকাতায় ফিরলে শেষকৃত্য সারা হয়েছিল। একাদশীর দুপুরে কবির শেষযাত্রার রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা রাজ্য প্রশাসন। কিন্তু গণেশ পাইনের শেষযাত্রায় তাঁকে ঘিরে রইলেন আত্মীয়রা, নবীন-প্রবীণ চিত্রশিল্পী- ভাস্কর থেকে শিল্পমোদীরাই। সংযত শোকের মোড়কে শেষযাত্রার পর্বটুকুও শান্ত, স্তিমিত। জনে-জনে শিষ্য তৈরি করেননি গণেশ। ছবি আঁকা শেখানো যায় বলেই মানতেন না। তবু একলব্যের মতো অনুরাগীরা এ দিন তাঁর আশপাশে। সনাতন দিন্দা, বিমল কুণ্ডু, সমীর আইচরাই শ্মশানে মরদেহ গাড়ি থেকে নামাতে এগিয়ে এলেন।
মঙ্গলবার সকালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন শিল্পী। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবার ও সুহৃদবর্গের তরফে তখনই ঠিক হয়, হাসপাতাল থেকে ‘সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস’ সংস্থার দফতর হয়ে মরদেহ সরাসরি কেওড়াতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে। কলুটোলার কাছে কবিরাজ রো-র যে প্রায়ান্ধকার গলির বাড়িতে গণেশ একদিন গোটা দুনিয়ার শিল্পরসিকদের টেনে এনেছিলেন, তা এই যাত্রাপথের বাইরেই থাকল। যতীন বাগচি রোডের যে বাড়িতে শেষ দিকে থাকতেন, সেখানেও ছোঁয়নি শেষযাত্রা। হাসপাতাল থেকে কসবায় শিল্পীদের সোসাইটির দফতরের পরে দেশপ্রিয় পার্ক হয়ে শেষযাত্রা পৌঁছয় কেওড়াতলায়। মৃত্যুর ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই যাবতীয় আচার মিটিয়ে শিল্পীর দেহ বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ঢুকে যায়।
শিল্পীর প্রয়াণের পরই অপরিচিত রাজনীতিবিদদের ভিড়ের আশঙ্কার কথা ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছিলেন পরিবারবর্গ। রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে এ দিন এসেছিলেন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। হাসপাতালে কিছু ক্ষণ ছিলেন। পরে শ্মশানে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় শ্রদ্ধা জানান। শিল্পীর শেষকৃত্যের অধ্যায়টিতে রাজনীতির সংস্রব বলতে এটুকুই। বাকি সময়টায় গণেশের মরদেহের পাশে রইলেন প্রধানত সেই সব শিল্পরসিক বা আত্মীয়-বন্ধু যাঁরা শেষ পর্যন্ত তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন।
সিমা গ্যালারি-র তরফে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় শিল্পীকে। ছিলেন সিমা-র ডিরেক্টর রাখী সরকার। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় দিল্লিতে ইন্ডিয়া আর্ট ফেয়ারে সিমা-র উদ্যোগে প্রদর্শিত হয় ‘গণেশ পাইন: হিজ মহাভারত’। সেখানে ছিল অম্বা, ব্লাইন্ড কিং, হিজ ড্রিম, অভিশাপ, ভীমসেন অ্যান্ড ঘটোৎকচ, ডেথ অফ কৃষ্ণ, এন্ড অফ দ্য ওয়ার-এর মতো কয়েকটি নতুন ছবি। সেটিই গণেশের ছবির শেষ প্রদর্শনী।
এ শহরের মর্যাদাপূর্ণ শিল্পী-গোষ্ঠী সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস-এর সঙ্গে গোড়া থেকেই ছিলেন গণেশ। এ দিন সোসাইটিতে শুভাপ্রসন্নর জন্য কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করা হয়। পরে শুভাপ্রসন্ন আসেন শ্মশানে। শেষকৃত্যের আগে একেবারে শেষ মুহূর্তে আসেন প্রবীণ চিত্রশিল্পী সুনীল দাশ। হাসপাতালে এসেছিলেন লালুপ্রসাদ সাউ। সরকারি আর্ট কলেজে এক ব্যাচের সতীর্থ লালুপ্রসাদ বলছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে গণেশের দুষ্টুমির কথা। “আমাদের কারও ছবি আঁকার সময়ে হয়তো হাত দিয়ে রংটা একটু ধেবড়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা চোটপাট করলে বলত, আঁকাটা হচ্ছিল না, ঠিক করে দিলাম।” লালুপ্রসাদের মতে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে বাংলার দেশজ
শিল্প-ঘরানাকে এ ভাবে আর কেউ মেলে ধরতে পারেননি। আবার একই সঙ্গে রেমব্রান্ট থেকে পল ক্লি সকলের শৈলী থেকে আহরণে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন।

শেষযাত্রায় গণেশ পাইন।—নিজস্ব চিত্র
সত্তরের দশকে ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’ পত্রিকাতে একটি লেখায় সেরা দশ নতুন শিল্পীর তালিকায় গণেশকে এক নম্বরে রাখেন মকবুল ফিদা হুসেন। তার আগেই অবশ্য লন্ডন-প্যারিস-প্রাগে প্রশংসার ঝড় তুলেছে গণেশের ক্যানভাস। জলরঙের আঙ্গিকে ঝকঝকে গাঢ় রঙের ‘টেম্পারা’ ঘরানায় ফুটে উঠেছে তাঁর ছবির অনন্য রহস্যময়তা। গণেশ হালুই এ দিন বলছিলেন, তাঁর থেকে বয়সে সামান্য ছোট বন্ধুপ্রতিম গণেশের ‘হারবার’ (বন্দর) ছবিটার কথা। নির্জন বন্দরের একটি জাহাজ ও একটিমাত্র মানুষের অবয়বে যেন কবেকার ইতিহাসের ভার। ঠিক যেন, জীবনানন্দের কবিতার বিষণ্ণতা।
শেষকৃত্যের সময়ে একটু দূরে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে গণেশ-জায়া মীরা, পাশে পুত্র ইন্দ্রনীল। ইন্দ্রনীল বলছিলেন, “একটাই শান্তি, ওঁকে বেশি কষ্ট পেতে হল না। উনি অসুস্থ দেখেই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ওখানে পৌঁছতেই সব শেষ।” শ্মশানে শিল্পীরা এক সঙ্গে গাইলেন আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। ইলেকট্রিক চুল্লির দরজাটা বন্ধ হওয়ার পরে মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। একক কণ্ঠে এক মহিলা হঠাৎ গেয়ে উঠলেন,
“শেষ নাহি তাই শূন্য সেজে
শেষ করে দাও আপনাকে যে
ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন
তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ...”

শোক ছাপিয়ে শিল্পী গণেশ পাইনকে বারবার আবিষ্কারের প্রত্যয় তখন মূর্ত হয়ে উঠেছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.