নিয়ম ছিলই, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই তা মানা হত না। ঠেকে শিখে এ বার সেই পুরনো নিয়মকেই ফের বলবৎ করতে উদ্যোগী হয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। তা-ও আবার খোদ মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিতে। স্থির হয়েছে, মহিলা কর্মীর উপস্থিতি ছাড়া কোনও রোগিণীকে পরীক্ষা করা কিংবা এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা চলবে না। প্রয়োজনে সরকারি হাসপাতালগুলিতে মহিলা কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হবে।
সরকারি হাসপাতালে একের পর এক শ্লীলতাহানির ঘটনায় উদ্বিগ্ন রাজ্য সরকার মহিলাদের রক্ষাকবচ হিসেবে চতুর্থ শ্রেণির মহিলা কর্মীদেরই ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি, রোগিণীদের সঙ্গে আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে চিকিৎসক, নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী-সকলের মধ্যেই সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচির প্রস্তাব দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এক্সপার্ট গ্রুপ’।
মহিলাদের শারীরিক ভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করার সময়ে কোনও মহিলা কর্মীর উপস্থিতি এমনিতেই বাধ্যতামূলক। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে রোগীর প্রবল চাপ এবং কর্মী সংখ্যা কম থাকায় বহু ক্ষেত্রেই সেই নিয়ম মানা হয় না। স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের ধারণা, এর ফলেই হাসপাতালে রোগিণীদের উপরে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ বাড়ছে। চলতি মাসেই দু’দিনের ব্যবধানে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পর পর দুটি শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। দুটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তি হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। প্রথম ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের পরে এক রোগিণীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার সময়ে তাঁর শ্লীলতাহানি করা হয় বলে অভিযোগ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অভিযোগ, স্ত্রী রোগ বিভাগের আউটডোর থেকে এক রোগিণীকে আলট্রাসোনোগ্রাফি করাতে নিয়ে গিয়ে এক সাফাইকর্মী তাঁর শ্লীলতাহানি করেন।
দুটি ক্ষেত্রেই কোনও মহিলা কর্মী সে সময়ে ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন না। পর পর এমন ঘটনায় বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী মহিলা কর্মীর সংখ্যা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য দফতরের এক্সপার্ট কমিটির চেয়ারম্যান সুব্রত মৈত্র জানিয়েছেন, রোগিণীদের সঙ্গে আচরণ কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীদের সচেতনতা বাড়ানোর কথা ভাবা হয়েছে। তাঁর মতে, শুধু সার্কুলার জারি করে এটা হয় না। এর জন্য লাগাতার কর্মসূচি প্রয়োজন। সুব্রতবাবু বলেন, “ডাক্তারদের মধ্যেও সতর্কতা বাড়াতে হবে। কারণ বহু ক্ষেত্রে রোগিণীদের অভিযোগ সত্যি হলেও, কিছু ক্ষেত্রে মানসিক বিকৃতি বা ফাঁসানোর উদ্দেশ্য থেকেও এমন অভিযোগ আসতে পারে। মহিলা অ্যাটেন্ড্যান্টদের উপস্থিতি এ ক্ষেত্রে রক্ষাকবচের কাজ করবে।”
সম্প্রতি রাজ্যের কিছু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ এ বিষয়ে সরব হওয়ায় পরিস্থিতি গুরুতর আকার নিয়েছে। ওই চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্য ভবনে জানান, রোগিণীদের কাছ থেকে তাঁরা আকছার চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পান। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগিণী বা তাঁদের পরিবার লিখিত অভিযোগ জানান না। উপরন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মীদের এ বিষয়ে কিছু বলতে গেলে তাঁরা মারমুখী হয়ে ওঠেন বা কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের পক্ষে চিকিৎসা চালাতে যে অসুবিধা হচ্ছে, সে কথা ওই চিকিৎসকেরা স্পষ্ট করেই জানান।
স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, শ্লীলতাহানি ঠেকাতে হাসপাতালের কর্মীদের ‘সংবেদনশীলতা’র পাঠ দেওয়া জরুরি, এটা তাঁরাও মানেন। কিন্তু শিখিয়ে-পড়িয়ে এমন বোধ কী ভাবে আনা সম্ভব, সে সম্পর্কে তাঁরা ধন্ধে।
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “মানসিক হাসপাতালগুলিতে এমন ঘটনা আকছার ঘটে। মনোরোগীরা এই ধরনের অত্যাচারের কথা বুঝিয়ে বলতে পারবেন না, কিংবা বললেও কেউ তা বিশ্বাস করবে না, এমন ধারণা থেকেই এই ধরনের অপরাধ বেশি ঘটানো হয়।”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, মানসিক হাসপাতালে যৌন নিগ্রহ ঠেকাতে কর্মীদের জন্য এক বার একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই কর্মশালায় উপস্থিতির হার ছিল নগণ্য। সংবেদনশীলতার পাঠ যে বিকৃতি ঠেকাতে কতটা কাজে লাগে, তখন থেকেই তা নিয়ে সংশয় রয়েছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। |