গত বছর পাশে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর হয়ে সাংবাদিকদের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে। আর এ বছর রাজ্য বাজেট পেশের পরে বিধানসভায় আনুষ্ঠানিক ভাবে সাংবাদিকদের মুখোমুখিই হলেন না অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তাঁর বদলে বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গেলেন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, অর্থমন্ত্রী অন্য কোনও দিন বাজেট নিয়ে প্রশ্নের জবাব দেবেন।
বিধানসভায় সোমবার অমিতবাবু ২০১৩ - ’১৪ অর্থবর্ষের বাজেট বরাদ্দ পেশ করার পরে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অপেক্ষায় ছিলেন অর্থমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক বৈঠকের জন্য। কারণ, বাজেট পেশ করার পরে ছোট -খাটো কোনও প্রশ্ন থাকলে অর্থমন্ত্রীই সাংবাদিক বৈঠক করে তার জবাব দেন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীরাও বাজেট পেশের পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে থাকেন। রীতি মেনে এ দিন বিরোধী দল সিপিএম এবং কংগ্রেস বাজেট নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চলে যায়। কিন্তু বিধানসভার মিডিয়া সেন্টারে আসেননি অর্থমন্ত্রী। তাঁর পরিবর্তে পরিষদীয় মন্ত্রী হিসাবে পার্থবাবু মুখোমুখি হন সাংবাদিকদের।
গত বছর অবশ্য বাজেট পেশের পরে সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর প্রায় কোনও ভূমিকাই ছিল না। অমিতবাবুকে পাশে বসিয়ে সাংবাদিকদের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অর্থমন্ত্রীকে দশে দশ দিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। এ বারও মনে করা হয়েছিল, হয়তো মুখ্যমন্ত্রীই অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করবেন। আশা করা হয়েছিল, রাজস্ব আদায় যখন বেড়েছে, তখন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হতে অর্থমন্ত্রীর হয়তো কোনও অসুবিধা থাকবে না। শেষ পর্যন্ত তিনি আর আসেননি। ঘন্টা দু’য়েক পরে তাঁর বদলে পার্থবাবু এসে সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের বক্তব্য জানালেও সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি ! যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর তিনি অর্থমন্ত্রীর জন্যই তুলে রেখেছেন!
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বিধানসভায় নিজের ঘরে অর্থমন্ত্রীকে পাশে বসিয়ে এ দিন বলেছেন, “শূন্য থেকে দাঁড়িয়ে আমাদের বাজেট করতে হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার যে বিশাল ঋণের বোঝা রেখে দিয়ে গিয়েছে, সেই পরিস্থিতিতে বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাজেট হয়েছে। সাধারণ মানুষের উপরে আর্থিক বোঝা না -চাপিয়ে বাজেট করা গিয়েছে। কারণ সুশাসন এবং ভাল অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা। যেটা দেশের মধ্যেই নয়, বিশ্বেও সেরা।”
বিরোধীরা মুখ্যমন্ত্রীর এই মূল্যায়নের সঙ্গে একেবারেই একমত নয়। বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস, দুই শিবিরই এ বারের রাজ্য বাজেটকে ‘দিশাহীন ও বিভ্রান্তিকর’ আখ্যা দিয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, “অর্থমন্ত্রী অর্থহীন বাজেট পেশ করেছেন! দিশাহীনও বটে। পর্বতের মূষিক প্রসব হয়েছে! এমন কিছু কথা আছে, অভিধান খুলে তার মানে খুঁজতে হবে! উদ্ধৃতির সংখ্যা বেড়েছে! নতুন কোনও প্রকল্প নেই। আগের চালু প্রকল্পেরই বেশ কিছু নাম বদলে দিয়েছেন। আর কেন্দ্রীয় প্রকল্পের উল্লেখই নেই !” তাঁর বক্তব্য, গত বারই ভ্যাট বাড়িয়ে আয়ের রাস্তা খোলার প্রস্তাব তাঁরা অর্থমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী তখন পণ্যে প্রবেশকর বসালেন। আবার এ বছর সেই প্রবেশকর রেখে দিয়েই ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের উপরে দু’দিক থেকে বোঝা চাপবে বলে সূর্যবাবুর অভিযোগ।
এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম নথিভুক্ত আছে কিন্তু চাকরি হয়নি, এমন এক লক্ষ কর্মহীনের জন্য মাসে দেড় হাজার টাকা করে ভাতা ঘোষণা হয়েছে এ বারের বাজেটে। যা নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের আগে প্রচারে নামবে শাসক দল। কিন্তু এই ভাতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা। সূর্যবাবুর ইঙ্গিত, এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে বেকার যুবক -যুবতীরা নাম লেখাচ্ছেন না। যে কারণেই সরকারের এই ভাতার টোপ দিয়ে বেকারদের আকর্ষণ করার চেষ্টা। তিনি বলেন, “আমরা হিসেব করে দেখেছি, এর জন্য বছরে ১৮০ কোটি টাকা লাগবে। সেটা কোথা থেকে আসবে, তার কোনও উল্লেখ নেই ! ” একই ভাবে বেকার ভাতায় আদতে সাধারণের কোনও উপকার হবে না বলে দাবি করে কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাবের বক্তব্য, “সব বেকার মানুষ তো এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন না। এই বেকার ভাতা তাঁরা পাবেনও না। তৃণমূল কর্মীরাই ভাতা পাবেন!”
রাজ্য সরকার যে ভাবে ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে, বাড়তি রাজস্ব -সহ যাবতীয় হিসাব ধরেও তা মেটানোর মতো আয়ের দিশা বাজেটে পাওয়া যায়নি বলে সমালোচনা করেছে বামেরা। বিরোধী দলনেতার মন্তব্য, “দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে মুখ্যমন্ত্রী যে সব ঘোষণা করেছেন, সেগুলো বাজেটে লিখে দেওয়াই অর্থমন্ত্রীর কাজ হয়েছে! তা -ও সব ঘোষণার আর্থিক সংস্থান এই বাজেটে নেই।”
মানুষের সংসারে বোঝা বাড়ার কথা বলে ভ্যাট -প্রশ্নে সরকারকে বিঁধেছেন সোহরাবও। এর পাশাপাশিই তাঁর অভিযোগ, “১০ লক্ষ কর্মসৃষ্টির কথা বলা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু কাজ সৃষ্টি মানে তো আর চাকরি নয়! মানুষকে ভাঁওতা দেওয়া হচ্ছে!” একই সঙ্গে আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতির রূপায়ণ এই সরকার করছে না বলে উল্লেখ করে সোহরাবের বক্তব্য, “যত স্কুল শিক্ষক নিয়োগের কথা গত বাজেটে বলা হয়েছিল, এ বারও একই কথা বলা হল। কত জনকে নিয়োগ করা হল, তার কিন্তু কোনও উল্লেখ নেই।” কত জন সংখ্যালঘুকে সরকারি দফতরে নিযুক্ত করা হয়েছে, তারও খতিয়ান বাজেটে নেই বলে কংগ্রেসের অভিযোগ। ১০ হাজার মাদ্রাসার অনুমোদন দেওয়ার কথা বলেছিল রাজ্য সরকার। কতগুলির অনুমোদন মিলেছে, তারও খতিয়ান বাজেটে নেই। কংগ্রেসেরই বর্ষীয়ান বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, “বাজেটে আর্থিক ঘাটতি ৮ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। কিন্তু এক নজরে বাজেটের নথিতে তা ৬ কোটি টাকা। কেন এই ফারাক? ইউরো জোনে সঙ্কটের পরে হাল ফেরাতে কেন্দ্র যে টাকা খরচ করেছে, তার উল্লেখ নেই!” বিজেপি -র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরও বক্তব্য, “দিশাহীন, গরিব -বিরোধী বাজেট। মূল্যবৃদ্ধিতে ভুগতে থাকা মানুষের উপরে বিক্রয়কর এবং ভ্যাট চাপিয়ে অর্থমন্ত্রী কার উপকার করলেন? অর্থমন্ত্রীরই পুরনো হিসাব আনুযায়ী, রাজ্যে বেকার ১ কোটি। ১ লক্ষকে ভাতা দিলে কী করে হবে?”
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে বলেন, “যারা এ সব বলছে, তারা কিস্সু বোঝে না! উৎপাদনে অনেক বেশি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যা সরবরাহের দিকটাকে ছাপিয়ে যাবে। সরবরাহ বাড়লে আর্থিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে।” আর পার্থবাবুর কটাক্ষ, বিরোধীরা বাজেট পড়ে ঠিক বুঝতে পারেনি। বলতে হয় তাই বলেছে। কেন্দ্রের বঞ্চনা, সিপিএমের জন্য মাথায় পাহাড় প্রমাণ ঋণের বোঝা নিয়েও অর্থমন্ত্রী এক অভূতপূর্ব এবং জনস্বার্থবাহী বাজেট পেশ করেছেন। পরিষদীয় মন্ত্রীর কথায়, “এই বাজেটে স্বচ্ছতা আছে। কাজ করার লক্ষ্য আছে। নতুন দিশা রয়েছে।” পার্থবাবুর দাবি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে সামান্য বেতনের কর্মী সকলের কথা অর্থমন্ত্রী ভেবেছেন। মুখ্যমন্ত্রী যে সার্বিক উন্নয়নের কথা বলেছেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে রাজ্যের বাজেটে।
রাজ্যপালের ভাষণের মতো এ দিন অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার সময়েও অবশ্য বিধানসভায় ছিলেন না গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার কোনও বিধায়ক।
|
এক ঝলকে |
• এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম নথিভুক্ত থাকলে ১,৫০০ টাকা ভাতা।
• মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতন বা মজুরি হলে বৃত্তিকর নয়।
• বাৎসরিক বিক্রি ৫০ লক্ষ টাকার নীচে হলে ক্রয়কর মকুব।
• ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সামান্য নথি দেখিয়ে নাম নথিভুক্ত করার সুযোগ।
• স্টক রেজিস্টার ছাড়াই ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিটের সুবিধা।
• সেল্ফ অডিট -এর ক্ষেত্রে বাৎসরিক বিক্রির সীমা বাড়িয়ে ৫ কোটি।
• চা বাগানগুলিকে শিক্ষা সেস ও কর্মসংস্থান সেসে ছাড় আরও এক বছর।
• দরিদ্র পরিবারের ১৩ -১৮ বছরের মেয়েদের পড়াশুনোর জন্য বছরে ৫০০ টাকা।
• প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা উৎসাহ ভাতা। |
|
ভ্যাট বাড়িয়ে কেন্দ্রের প্রস্তাব মানল রাজ্য
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রাজস্ব বাড়ানোর দোহাই দিয়ে হলেও অবশেষে মূল্যযুক্ত করের (ভ্যাট) নিম্নতম হার বৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব মেনে নিল রাজ্য। এর ফলে গোটা দেশে কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর (সিএসটি) প্রত্যাহার করে পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু করার ব্যাপারে কেন্দ্র আরও এক ধাপ এগোলো বলে মনে করা হচ্ছে। সোমবার বিধানসভায় বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ভ্যাট-এর নিম্নতম হার ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখেন। এ যাবৎ অর্থমন্ত্রীদের এমপাওয়ার্ড কমিটিতে এই হার বৃদ্ধির বিরোধিতাই করে এসেছে রাজ্য। বলা হয়েছে, এর ফলে সাধারণ মানুষের ওপর বোঝা চাপবে। কিন্তু এর ফলে ২০১০-২০১১ থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের অংশ হিসেবে প্রাপ্য ১৮৩৮ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা হারিয়েছে এই রাজ্য। এ বার ভ্যাটের সর্বনিম্ন হার বাড়িয়ে অমিত মিত্র কার্যত মেনে নিলেন, রাজস্ব বাড়াতে কেন্দ্রের দাওয়াই-ই অব্যর্থ। |