চ্যাপেল আর গঙ্গোপাধ্যায়—দুটো পদবির মধ্যে বোধহয় ক্রিকেট দর্শনে কখনও মেলার নয়! নইলে তর্কযোগ্য ভাবে সফরে থাকা অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি ঘটার বারো ঘণ্টার মধ্যে প্রকাশিত দুটো মতামতও কী ভাবে দুই মেরুর বাসিন্দা! “প্যাটিনসনরা মোহালিতে খেলবে না এখনই সিওর করে বলা যায় না। নিশ্চয়ই একটা কিছু ঘটবে। অস্ট্রেলীয় বোর্ড হস্তক্ষেপ করবে।” বক্তার নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। “বোঝাই যাচ্ছে যা হয়েছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া-র সম্মতি আর পরামর্শ মেনে হয়েছে।” বক্তার নাম ইয়ান চ্যাপেল।
কিন্তু বিশ্বক্রিকেটকে স্তম্ভিত করে দেওয়া সপ্তাহের প্রথম দিনের ইস্যুটা নিছক সৌরভ বনাম চ্যাপেল নয়। তার চেয়ে অনেক বড়। অনেক ঐতিহাসিক। তৃতীয় বিশ্বের ক্রিকেট শৃঙ্খলা বনাম প্রথম বিশ্বের ক্রিকেট শৃঙ্খলার প্রাচীন দাঁড়িপাল্লার দৃশ্যত সংশোধন! আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সার্কিটে একটা সযত্নলালিত ধারণা চিরকাল আছে। যাকে বলা যেতে পারে ধারণার অ্যাপার্থাইড। শৃঙ্খলাভঙ্গ ব্যাপারটা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ভারতেরই একচেটিয়া। অর্থাত্ টিমের মধ্যে হানাহানি, কাটাকাটি এগুলো করে থাকে কেবল কৃষ্ণাঙ্গ দেশের খেলোয়াড়রাই। মোহালিতে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে সেটা পাকিস্তান বা ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ঘটলে শ্বেতাঙ্গ সংবাদমাধ্যমে তার চিরকালীন বহিঃপ্রকাশ ঘটত ধরেই নেওয়া যায়। সচিনদের শেষ অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় যেমন নিয়মিত ভাবে ভারতীয় শিবিরের আভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিয়ে অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম গোটা গ্রীষ্মকাল তীব্র হাসিঠাট্টায় মেতে থেকেছে। গাওস্কর-সহ ভারতীয় ক্রিকেটাররা বিভিন্ন সময়ে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন দলগত সংহতির অভাবটা আদৌ উপদেশীয় রোগ নয়। তৃতীয় বিশ্বের ভাইরাসও না। সব ড্রেসিংরুমেই কমবেশি আছে। কারওটা প্রচার পায়, কারওটা পায় না। ক্রিকেট সার্কিটে যখন এ রকম একটা পাল্টা প্রতিবাদী ধারণা উড্ডীয়মান হতে থাকে, তখন শ্বেতাঙ্গ মিডিয়া এত দিনের ভাবমূর্তিটা সামান্য সংশোধন করে। বলতে থাকে, টিমের মধ্যে যদি বা সমস্যা থাকে শ্বেতাঙ্গ দেশগুলো এতই পেশাদার যে, মাঠে সেই ব্যক্তিগত সম্পর্কের অভাবকে প্রশ্রয় দেয় না। ধোনি এবং সহবাগ একই দলে থেকে যে বিশ্বকাপ জিতেছেন, সেটা তুলে ধরে ভারতীয় মিডিয়া কখনও বলেনি যে এরা মাঠে শুধু পাশাপাশি স্লিপ আর উইকেটকিপারই দাঁড়ায়নি, একসঙ্গে দেশকে বিশ্বকাপও দিয়েছে। অস্ট্রেলীয় মিডিয়া কিন্তু বারবার জাঁক করে বলেছে, স্টিভ ওয় আর শেন ওয়ার্নের বন্ধুত্ব নেই। বন্ধুত্ব নেই ওয়ার্ন আর গিলক্রিস্টে। কিন্তু ব্যাগি গ্রিন টুপির তলায় ওরা সবাই এক!
ভারতীয় বা পাকিস্তানিরা ফের বলার চেষ্টা করেছেন, দাবিটা অসার। কিন্তু কেউ সেই আওয়াজকে পাত্তাও দেয়নি। সোমবার ক্রিকেটবিশ্বে প্রথম প্রামাণ্য হল যে, দলগত শৃঙ্খলার অভাবটা কালোদের একচেটিয়া ভাইরাস নয়।
বিকেলে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে ফোন করে দেখা গেল সর্বসম্মত ধারণাসিদ্ধান্তে কোচ মিকি আর্থারের ভূমিকা নিছকই প্রচার সচিবের। শাস্তির সিদ্ধান্তটা পুরোপুরি মাইকেল ক্লার্কের। আর সমস্যাটা মোটেও তিনটে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নিয়ে নয়। সফরের শুরু থেকেই টিমে ধিকিধিকি জ্বলছিল। ০-২-এর হাওয়ায় আরও দাউদাউ করে ছড়িয়ে পড়ল। সফরের শুরু থেকেই সহ-অধিনায়ক ওয়াটসন আর ক্যাপ্টেন ক্লার্কের সম্পর্ক খারাপ ছিল। প্রকাশ্য গ্রুপ ছিল টিমে দুটো। ক্যাপ্টেন আর ভাইস ক্যাপ্টেন। এমনকী ওয়ার্নার আর কাওয়ান, যাঁরা ওপেন করতে নামেন, তাঁরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না। ওয়ার্নার আর ওয়াটসনে আবার খুব খারাপ সম্পর্ক। অজি সাংবাদিকরা বলছিলেন, ব্যাগি গ্রিনের চুম্বক এই সব বিরোধ ঢেকে দিতে পারে। চিরকাল যেমন দিয়েছে। সোমবারের পর তাঁদের দাবি সুমেরুতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কেভিন পিটারসেন-বিতর্কের পর ব্রিটিশ প্রেস অবশ্য এই নিয়ে অনেক দিনই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কারও কারও অবশ্য মনে হচ্ছে আধুনিক সময়ে ইস্যুটা কালো বনাম সাদা দেশের শৃঙ্খলার মধ্যেও নেই। কৃষ্ণাঙ্গ দেশের ক্রিকেটাররা আত্মপ্রসাদ পেতেই পারেন যে, অ্যাদ্দিন আমাদের বলত, এ বার ওরা ফাঁসল। আজ আমাদের দিন। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, ভাবমূর্তিতে এত বছর পিছিয়ে থেকে ১-১ করে দেওয়ার এই উল্লাসে আদৌ কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কি না? নাকি আধুনিক পেশাদারের চিন্তাভাবনা এই যুদ্ধটাকেই অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করেছে?
নতুন ধারণা বলছে, আধুনিক সময়ে সেরা পেশাদাররা দেশের হয়ে খেলার সময় যথেষ্ট সহ্যশক্তি দেখাতেই রাজি নন। আর্জেন্তিনা শিবিরে মেসির যা সমস্যা হয়, ওয়াটসনের তা-ই হয় অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে গেলে। আইপিএলে শেন ওয়াটসন রাজস্থানের হয়ে এত দিন খেলেছেন। কখনও কোনও অভিযোগ ওঠেনি। পিটারসেনের বেঙ্গালুরুতে সমস্যা হয় না। দিল্লিতে হয় না। লর্ডসে হয়। ওয়ার্নার খেলেন দিল্লির হয়ে। গেইল খেলেন বেঙ্গালুরুর হয়ে। এঁরা বিগ ব্যাশেও খেলেন। কখনও কোটি টাকার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ক্লাব দলের হয়ে এঁদের কোনও মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা হয়নি। সবার সমস্যা যেন হয় দেশের হয়ে খেলতে এলেই।
এটা অবশ্যই ঠিক যে, স্টিভের সোনার দলে অনেক বিভাগ ছিল। যেমন ছিল লয়েডের অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটানো টিমে। কিন্তু সেই সময়টা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। দেশের হয়ে খেলাই তখন পেশাদারের একমাত্র আয়ের প্রধান উপায় ছিল। কোনও বিকল্প ছিল না। আইপিএলের যুগে চালচিত্রটা বদলে গিয়েছে। ব্যাগি গ্রিন কি বদলে যাওয়া সময়ের তলাতেই চাপা পড়ল? যেখানে ক্লাব দেশের চেয়ে বেশি টাকা দেয়! সেরা চুম্বক তাই ব্যাগি গ্রিন নয়—মানি গ্রিন!
সত্যি তাই? বাকি থাকা আগামী দশ দিনের সিরিজ সমস্যার আরও ভাল করে স্ক্যানিং করবে। |