ভারত সফরের মাঝপথে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে যে এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, কে জানত!
অস্ট্রেলীয় কোচ মিকি আর্থারের চরম নাটকীয় সিদ্ধান্ত। আর তাকে কেন্দ্র করে তুমুল অশান্তি বেঁধে গেল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট সংসারে। শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে টিমের সহ অধিনায়ক শেন ওয়াটসন, সেরা পেসার জেমস প্যাটিনসন, মিচেল জনসন এবং উসমান খোয়াজাকে মোহালি টেস্টে নির্বাসনে পাঠালেন আর্থার। যে সিদ্ধান্তকে শুধু ‘মূর্খামি’ বলে রেহাই দিচ্ছে না ক্রিকেট বিশ্ব। ইয়ান চ্যাপেল থেকে শুরু করে রিচি বেনোর মতো প্রাক্তন মহাতারকাদের কেউ কেউ স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন, অবলুপ্তির পথ ধরছে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট!
ঘটনাবলীর বিবরণ আশ্চর্যের বললেও বোধহয় কম বলা হয়। বরং অনেক বেশি স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো। হায়দরাবাদ বিপর্যয়ের পর আর্থার টিমের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ঠিক কী কী করলে বাকি সিরিজে পাল্টা জবাব দেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে নিজেদের পারফরম্যান্সেও কী ভাবে উন্নতি ঘটানো যাবে। ক্লার্ক-ওয়াটসনদের প্রেজেন্টেশন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সবাই দিয়েছিলেন, শুধু ওয়াটসন-সহ চার জন বাদে।
যা দেখে নাকি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় আর্থারের। এবং এর পরপরই অস্ট্রেলীয় কোচ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, মোহালির টিমে এই চার জন থাকবেন না। তাতে যা হওয়ার হবে। ওয়াটসনরা নির্বাসিত! “আমি ওদের পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছি, টিম কী ভাবছে ওদের নিয়ে। হায়দরাবাদের পর গোটা টিমটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সবাইকে বলেছিলাম, তোমরা প্রত্যেকে আলাদা প্রেজেন্টেশন দাও। জানাও কী ভাবে টিমটা টেকনিক ও মানসিক ভাবে উঠে দাঁড়াতে পারে। সিরিজে ফিরে আসতে পারে। তিনটে পয়েন্ট চাওয়া হয়েছিল,” সোমবার নিজের মহানাটকীয় সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলে বসেন অস্ট্রেলীয় কোচ। |
শেন ওয়াটসন |
জেমস প্যাটিনসন |
মিচেল জনসন |
উসমান খোয়াজা |
|
শুধু তাই নয়, ভাল রকম শ্লেষ মিশিয়ে সঙ্গে যোগ করেন, “দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ওই চার জনের থেকে যা চেয়েছিলাম, পাইনি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের একটা গর্ব আছে। ঐতিহ্য আছে। সংস্কৃতি আছে। একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি ধরে আমরা বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করতে চাই।” শেষে বলেন, “এই চার জনের আচার-আচরণ সেই সংস্কৃতির সঙ্গে মেলেনি। তাই ওদের বাদ দিয়েই অস্ট্রেলিয়া মোহালিতে নামবে।”
আগুনে ঘৃতাহুতি ঘটাতে যা যথেষ্ট ছিল।
নির্বাসনের ঘোষণা শোনার পর দুপুর-দুপুর অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইট ধরে ফেলেন ওয়াটসন। মুহূর্তে প্রবল জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে, কোচের সঙ্গে তীব্র ঝামেলার পরিণতিতেই সফরের মাঝপথে ফিরে যাচ্ছেন ওয়াটসন। টিমের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হয় যে, ওয়াটসনের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। তাই দেশে ফিরছেন। যেহেতু স্ত্রী লি-কেও ওয়াটসনের সঙ্গে ফিরতে দেখা গিয়েছে। এয়ারপোর্টেও নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। চণ্ডীগড় এয়ারপোর্টে তার কিছুক্ষণ আগেই নেমেছেন ব্র্যাড হাডিন। চোটগ্রস্ত ম্যাথু ওয়েডের বদলে যাঁকে অস্ট্রেলিয়া থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছে। কাছাকাছি সময়ে ওয়াটসনও চণ্ডীগড় এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইট ধরলেন, তবে ফেরার। এবং তার আগে স্পষ্ট শুনিয়ে রেখেছেন, এর পর আর ব্যাগি গ্রিন পরে নামবেন কি না ভেবে দেখতে হবে তাঁকে। ৩১ বছরের অজি অলরাউন্ডারের কথায়, “ক্রিকেটটা আমি খেলতে ভালবাসতাম। কিন্তু এর পর জানি না টেস্ট ক্রিকেট খেলব কি না। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে সব নিয়ে। কোনও অন্যায় না করে যদি নির্বাসিত হতে হয়, প্রচণ্ড আঘাত লাগে।”
মাইকেল ক্লার্ক বলার চেষ্টা করছেন যে, কোনও বিছিন্ন ঘটনার জেরে তাঁর ডেপুটি সহ চার জনকে নির্বাসিত হতে হল, এমন নয়। ক্লার্ক বলছেন, “এই সফরে অনেক কিছুই ঘটছে যা অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের সঙ্গে মাননসই নয়। যে উচ্চতায় নিজেদের তোলা উচিত, সেটা পারছি না।” এখানে না থেমে অজি অধিনায়কের পরবর্তী সংযোজন, “অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট মধ্যবিত্ত মনোভাবে বিশ্বাসী নয়। আপনাদের মনে হতে পারে যে, আমি পক্ষপাতিত্ব করছি। কিন্তু বাকি টিমের চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার কিছু ফারাক আছে। তাই ওয়াটসনদের নির্বাসন কোনও বিছিন্ন ঘটনার জন্য হয়নি।”
ক্লার্ক পরোক্ষে কোচের পাশে। কিন্তু তাতে আর লাভ হচ্ছে কোথায়? আর্থারের ‘থ্রি পয়েন্ট থিওরি’-কে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করছে বিশ্বের ক্রিকেটমহল। উল্টে সাফ জানাচ্ছে, এমন বালখিল্যসুলভ আচরণ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের পরিপন্থী। |
যেমন অ্যালান বর্ডার। ইয়ান চ্যাপেল। রিচি বেনো। ডিন জোন্স। কে কী বলছেন, নীচে তুলে দেওয়া হল।
অ্যালান বর্ডার: এটা কি ক্লাস সিক্সের ক্লাসরুম নাকি? সময়ে খাতা জমা দিতে হবে? হাস্যকর ঘটনা।
ইয়ান চ্যাপেল: মারাত্মক ভুল হল। ওয়াটসন, প্যাটিনসন চলে গেলে টিমটার মানসিক কী অবস্থা হবে ভাবতে পারছি না। আর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার মদত ছাড়া এটা হয়নি, বিশ্বাস করি না।
রিচি বেনো: আমরা এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে অনুসরণ করছি। পরবর্তী প্রজন্মকে তুলতে পারছি না, এ ওকে দোষারোপ করছি।
মাইকেল ভন: অজি ক্রিকেটে কী হচ্ছে এ সব? জানা ছিল না, দলে নির্বাচিত হতে গেলে এখন ভাল রচনা লেখাও জরুরি!
চতুর্দিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ঝড়। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের তুলোধোনা। কোথাও অস্ট্রেলীয় প্রচারমাধ্যমের। একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মিকি আর্থারের কার্টুন বেরিয়েছে। একটা ব্যাটের ছবি। আর্থার তার বিভিন্ন অংশ বোঝাচ্ছেন, এটাকে ব্যাটের ব্লেড বলে...এই জায়গাটা দিয়ে স্ট্রোক খেলতে হয়...।
কোথাও আবার লেখা হচ্ছে, বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল। গত অস্ট্রেলিয়া সফরে ধোনিদের ০-৪ ‘হোয়াইটওয়াশ’-এর পর টিম ইন্ডিয়ার ড্রেসিংরুমের ঝামেলাকে প্রকাশ্যে আছড়ে ফেলেছিল অজি মিডিয়া। বোঝা যায়নি, সেই নাটকের ‘ড্রপসিন’ পড়বে এখানে, এই ভারত সফরে এসে! |
দল আর কোচকে অসম্মান করা বরদাস্ত করব না মাইকেল ক্লার্ক |
‘কঠিন সিদ্ধান্ত হলেও এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিমের সাফল্যের জন্য যা যা দরকার, আমরা তা করে উঠতে পারিনি এখনও। প্রথম দুই টেস্টে হার কাকতালীয় নয়। দুটো দলের মধ্যে মানে অনেকটাই ফারাক হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ক্রিকেট মাঠে নামলে পারফরম্যান্সের সঙ্গে শৃঙ্খলা, সংস্কৃতির মতো শব্দগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। দ্বিতীয় টেস্টের পর কোচ শারীরিক এবং মানসিক ভাবে তরতাজা হয়ে ওঠার জন্য দু’দিন সময় দিয়েছিলেন। কারণ পরবর্তী দুই টেস্টে ফিরে আসাটা দলের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। তাই কোচ দলের প্রত্যেক সদস্যের কাছে জানতে চান কী ভাবে খেলার উত্কর্ষ বাড়বে। সিরিজে ফিরে আসতে গেলে তার কাছ থেকে কী সহায়তা পাওয়া যাবে। কিন্তু ওই চার ক্রিকেটার ব্যাপারটাকে গুরুত্বই দেয়নি। এটা দলের সঙ্গে কোচকেও অসম্মান করার সামিল।’ |
|
প্রত্যেকেই জানে কোন নিয়ম ভাঙলে কী শাস্তি হয়
শেন ওয়াটসন |
‘অবিশ্বাস্য কোনও ভুল হলেই টেস্ট দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। প্রত্যেকেই জানে কোন নিয়ম ভাঙলে কী শাস্তি হয়। যা হল সেটা সত্যিই কঠোর সিদ্ধান্ত। আমি চাই লোকে আমাকে একজন সত্ ক্রিকেটার হিসাবেই মনে রাখুক। সে ভাবেই ক্রিকেটটা এতদিন খেলে এসেছি এবং আগামী দিনেও একই ভাবে খেলতে চাই। ক্রিকেটের প্রতি আমার ভালবাসা নিয়ে কোনও প্রশ্ন আশা করি উঠবে না। আসন্ন কয়েক সপ্তাহে পরিবারের সঙ্গে বসে ঠিক করব পরবর্তী ক্রিকেট-পরিকল্পনা। তবে আমি মনে করি ক্রিকেটকে আমার এখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। সোমবার সকালে কোচ এবং অধিনায়ককে বলতে চেয়েছিলাম সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য দিল্লির চতুর্থ টেস্টে থাকা সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু তার আগেই এল আঘাত। টিম ম্যানেজমেন্ট জানিয়ে দিল, তৃতীয় টেস্টে আমি নেই।’ |
|