খুন, দাবি পরিবার-কৌঁসুলির
তিহাড়ে উদ্ধার দিল্লি ধর্ষণে অভিযুক্তের দেহ
ত্মহত্যা যাতে না করতে পারে তার জন্য বিশেষ নজর রাখা হয়েছিল। তবুও আজ তিহাড় জেলের সেল থেকে উদ্ধার হল দিল্লি গণধর্ষণে অন্যতম অভিযুক্ত বাসচালক রাম সিংহের ঝুলন্ত দেহ। জেল কর্তৃপক্ষ আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও এই মৃত্যু ঘিরে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
রাম সিংহকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার আইনজীবী এ পি সিংহ ও পরিবারের সদস্যরা। সুরক্ষিত জেলে রাম কী ভাবে আত্মহত্যা করল সেই প্রশ্নের জবাব পেতে আপাতত মরিয়া কেন্দ্রীয় ও দিল্লি সরকার। জেল কর্তৃপক্ষের তরফে বড় ধরনের গাফিলতি হয়েছে বলে মেনে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে।
দিল্লি গণধর্ষণে ধর্ষিতার উপরে অত্যাচার দেখে বিস্মিত হয়েছিল পুলিশও। যে বাসে ঘটনা ঘটেছিল, তার চালক ছিল রাম। আদতে রাজস্থানের বাসিন্দা রাম দিল্লির একটি বস্তিতে থাকত তার ভাই মুকেশের সঙ্গে। পুলিশের তদন্তে প্রকাশ, বরাবরই অসহিষ্ণু, মদ্যপ ছিল সে। রামের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল তার তিন ভাই। প্রায়ই মদ খেত রাম। আর তার পরে নিজের মেজাজের উপরে কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকত না তার।
তিন বছর আগে মারা যান রামের স্ত্রী। তার পর থেকেই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল সে। একটি দুর্ঘটনার ফলে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার করা হয় তার দেহে। সেই ঘটনাও রামের রাগ আরও বাড়িয়ে দেয়। বাস-মালিকদের সঙ্গে বেশ কয়েক বার গোলমাল হয়েছে তার।
এ হেন রামকে তিহাড় জেলে রাখার সময়ে তার উপরে বিশেষ নজর রাখা হয়েছিল। কারণ, সে অবসাদে ভুগছে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। দিল্লি গণধর্ষণ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচুর হইচই হয়। ফলে, জেলের অন্য বন্দিরা এই মামলায় অভিযুক্তদের উপরে হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল পুলিশের। সেই কারণেও কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
৩ নং তিহাড় জেলে একটি সেলে অন্য তিন বন্দির সঙ্গে ছিল রাম। সেলের বাইরে সব সময়েই মোতায়েন থাকতেন এক জন রক্ষী। তিহাড় জেলের একটি সূত্রে খবর, নিজের জামাকাপড় দিয়ে একটি দড়ি তৈরি করেছিল রাম। ভোররাতে একটি কাঠের টুলের উপরে উঠে আট ফুট উঁচুতে ভেন্টিলেটরের গরাদের সঙ্গে ওই দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ে সে। বাকি কয়েদিরা ঘুমোচ্ছিল।
ছেলের মৃত্যুর খবরে ভেঙে পড়েছেন রাম সিংহের মা। ছবি: রয়টার্স
ফলে, তারা কিছু জানতে পারেনি। কিছু বুঝতে পারেননি সেলের বাইরে মোতায়েন রক্ষীও। ভোর পাঁচটা নাগাদ রামের ঝুলন্ত দেহ দেখতে পাওয়া যায়।
জেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা রামকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ময়না-তদন্তের জন্য রামের দেহ দীনদয়াল উপাধ্যায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু, সেলের অন্য কয়েদি ও রক্ষীর এই কিছু না জানার তত্ত্ব মানতে রাজি নয় রাম সিংহের পরিবার। তাদের দাবি, ঘটনার সিবিআই তদন্ত হওয়া উচিত। রামের বাবা মাঙ্গে রামের বক্তব্য, “আমার ছেলে আত্মহত্যা করেনি। ওকে খুন করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। রামের হাত ভাঙা ছিল। ওর পক্ষে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়।” অবশ্য সে কথা মানতে রাজি নন পুলিশ-কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, “রাম ওই হাত নিয়ে বাস চালিয়েছে। খুন-ধর্ষণ করেছে। আত্মহত্যা করা তার পক্ষে কঠিন কিছু নয়।”
রামের আইনজীবী ভি কে আনন্দের মতে, “এই ঘটনায় নিশ্চয়ই কোথাও কোনও গোলমাল আছে। রাম মামলার গতিপ্রকৃতিতে খুশিই ছিল। ও আত্মহত্যা করতে পারে না।” তাঁর দাবি, জেলে রামের উপরে অত্যাচার করা হয়েছিল। সে কথা মানতে রাজি নন জেল কর্তারা। তবে জেলে অন্য বন্দিরা রাম ও ধর্ষণ মামলায় অন্য অভিযুক্তদের প্রথমে মারধর করেছিল বলে মেনে নিয়েছেন তাঁরা। তখন ওই অভিযুক্তদের আলাদা সেলেও রাখা হয়েছিল। পরে অবশ্য তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি।
ধর্ষণ মামলায় অন্য দুই অভিযুক্তের কৌঁসুলি এ পি সিংহের বক্তব্য, “এই মামলার অভিযুক্তদের জন্য তিহাড় যে আদৌ নিরাপদ নয় তা বোঝা গেল। আমার মক্কেলদের জামিনের জন্য আবার আর্জি জানাব।” দিল্লিতে এই ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রবল আলোড়ন হয়েছে। তাই অভিযুক্তদের বিচার অন্য কোথাও করার আবেদন জানিয়েছিলেন অভিযুক্তদের আর এক কৌঁসুলি এম এল শর্মা। সে আবেদন খারিজ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। শর্মা জানিয়েছেন, ফের সুপ্রিম কোর্টে ওই আর্জি পেশ করবেন তিনি।
রাম সিংহের মৃত্যু নিয়ে স্বভাবতই চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক শিবিরে। ঘটনাটি যে জেল কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতার পরিচায়ক তা স্বীকার করে নিয়েছেন সুশীলকুমার শিন্দে। ঘটনাটি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের আদেশ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আজ শিন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত। বৈঠকে দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রের হাতে থাকার বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা হয়েছে বলে সরকারি সূত্রে খবর। কারণ, পুলিশ শীলার হাতে না থাকলেও কারা দফতর তাঁর অধীন। ফলে, এ ক্ষেত্রে দায় নিতে হবে শীলাকেই। দিল্লি পুলিশ নিজের হাতে না থাকলে এত দায় নিতে রাজি নন শীলা। বৈঠকের পরে শিন্দে সাফ জানিয়েছেন, শীলার উচিত তাঁর বক্তব্য লিখিত ভাবে কেন্দ্রের কাছে পেশ করা। শীলা কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী ও সফল মুখ্যমন্ত্রী। তাই তাঁর দাবি কংগ্রেস নেতৃত্ব নিশ্চয়ই মেনে নেবেন।
রামের মৃত্যু নিয়ে তিহাড় জেল কর্তৃপক্ষ একটি রিপোর্টও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে। সেই রিপোর্টে অবশ্য এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই দাবি করা হয়েছে। জেলের দাবি, নিজের জামাকাপড় ও শতরঞ্চি দিয়ে দড়ি তৈরি করেছিল রাম। খাওয়ার থালা দিয়ে শতরঞ্চি কেটে ফেলেছিল সে। তিহাড়ের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল কিরণ বেদী জানিয়েছেন, শতরঞ্চি কেড়ে নিলে আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠবে। জেলের গরাদও সরানো সম্ভব নয়। রক্ষীদের সতর্ক থাকা ছাড়া পথ নেই।
আপাতত ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের অজুহাতেই সব প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইছেন তিহার জেলের ডিরেক্টর জেনারেল বিমলা মেহরা। কিরণ বেদীর মতে, কোনও আসামির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিতেই পারে। সব বন্দিদের মধ্যেই কমবেশি ওই প্রবণতা থাকে। বিশেষ করে সে যখন বুঝে যায়, তার শাস্তি থেকে বাঁচার কোনও পথ নেই, তখন সে আত্মহত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকে।
কিরণের মতে, রক্ষীদের সব সময়ই সতর্ক থাকতে হয়। সিসিটিভি ক্যামেরা ও রক্ষীদের নজরদারি এড়িয়ে কী ভাবে রাম সিংহ আত্মহত্যা করল, সেই প্রশ্ন রয়েছে। রাম সিংহের উপরে কী ভাবে নজর রাখা হয়েছিল, আর সে কী ভাবেই বা সেই নজর এড়িয়ে এই কাজ করল তা জানতে হবে। তদন্ত ছাড়া তা জানা যাবে না। প্রয়োজনের তুলনায় জেলকর্মী কম থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কিরণ।
তবে এই মৃত্যু যে তিহাড়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে তা মেনে নিচ্ছেন অনেকেই। তিহাড়ের বাইরে নজরদারির দায়িত্বে আছে আধাসেনা। বিভিন্ন গেটে তল্লাশির দায়িত্বে আছে তামিলনাড়ু বিশেষ পুলিশ। রামকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্বেও ছিলেন ওই বাহিনীর এক জওয়ান। নজর এড়িয়ে কী ভাবে রাম আত্মহত্যা করল তা নিয়ে রীতিমতো ধন্দে সরকার।

হতাশ দামিনীর পরিবার, ক্ষুব্ধও
রাম সিংহের আত্মহত্যার খবরে স্তম্ভিত দামিনীর পরিবার। খানিকটা ক্ষুব্ধও। কারণ রাম সিংহ নিজে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে পারে না বলেই মনে করছেন নিহত দামিনীর ভাই। তিনি বলেন, “ও (রাম) জানতই যে ও মারা যাবে। কারণ ওর বিরুদ্ধে জোরালো প্রমাণ ছিল। চাইতাম প্রকাশ্যে ওর ফাঁসি হোক। ও নিজেই মৃত্যু বেছে নিল। এটা ঠিক হল না।” রাম সিংহের মৃত্যুর পর গণধর্ষণ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দামিনীর বাবা। তাঁর প্রশ্ন, “ওরা ওকে মরতে দিল কেন?” তাঁর মতে, “পুলিশ ব্যর্থ। মামলার কী হবে, সেটাই চিন্তা।” তরুণীর মা বলেন, “মেয়ের সুবিচার চেয়েছিলাম। মূল অভিযুক্তই মারা গেল। হয়তো ও অপরাধবোধে ভুগছিল।”

১৫ মাসে ৩ বন্দির আত্মহত্যা
দিল্লি গণধর্ষণের অন্যতম অভিযুক্ত রাম সিংহের আত্মহত্যা নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে দেশের অন্যতম হাই-প্রোফাইল এই জেল কতটা সুরক্ষিত। তবে পরিসংখ্যান বলছে, তিহাড়ে বন্দিদের আত্মহত্যা নতুন ঘটনা নয়। গত ১৫ মাসে তিহাড়ের তিন বন্দি আত্মহত্যা করেছে বলে জেল সূত্রে খবর। সোমবার সকালে তিন নম্বর জেলের নিজের সেলে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় রাম সিংহের। তিহাড়ের ডিজি বিমলা মেহরা জানান, গত বছর মোট ১৮ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছিল। যার মধ্যে দু’টি ছিল আত্মহত্যার ঘটনা। বাকিদের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। চলতি বছরে রাম সিংহের আগে কোনও আত্মহত্যার ঘটনা তিহাড়ে ঘটেনি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.