মাঝে মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধান। বাংলাদেশ সফর সেরে দেশে ফিরেছেন গত মঙ্গলবার। আজ ফের সফরে বেরিয়ে ভারত মহাসাগরের বুকে এই দ্বীপরাষ্ট্রে এসে পৌঁছলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ‘আহ মরি মরিশাস’! আফ্রিকা মহাদেশের যে ভূখণ্ডের সঙ্গে ভারতবর্ষের নাড়ির সম্পর্ক।
ভারত-মরিশাস সম্পর্কের ইতিহাস প্রায় দু’শো বছরের। পোর্ট ল্যুই বিমানবন্দরে ভারতীয় রাষ্ট্রপতির অভ্যর্থনায় সামরিক আয়োজন, তোপধ্বনি, বিমানবন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত প্রশস্ত সড়কের পাশে দু’দেশের পতাকা, ফেস্টুন, মখমলের মতো সবুজে মোড়া শহরের উন্মাদনা মিলেমিশে সেই সম্পর্ক যেন আজ আরও মূর্ত হয়ে উঠেছে। কাল এ দেশের জাতীয় দিবস। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্যই এ দেশে আসা ভারতীয় রাষ্ট্রপতির। অনুষ্ঠান শেষে দেশে ফিরবেন পরশু।
তা হলে কি স্রেফ আনুষ্ঠানিক (সেরিমোনিয়াল) কারণেই রাষ্ট্রপতির এই ঝটিকা সফর? তবে যে প্রণব মুখোপাধ্যায় সরকারের কর্তাদের জানিয়েছিলেন, আনুষ্ঠানিক সফরে তাঁর বিশেষ ইচ্ছা নেই! |
মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী নবীনচন্দ্র রামগুলামের সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতি। —নিজস্ব চিত্র |
প্রশ্ন শোনা মাত্রই দ্রুত ধারণা শুধরে দিলেন রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের এক শীর্ষ আমলা। বললেন, “কে বলল শুধু আনুষ্ঠানিক এই সফর? আর কে-ই বা জানাল, কূটনীতির দৌত্য নেই? অনুষ্ঠানের আড়ালে সব বৈঠক জুড়েই থাকবে শুধু কূটনীতি। আরও স্পষ্ট করে বললে, অর্থনৈতিক কূটনীতি।”
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সফররত রাইসিনার ওই কূটনীতিক এখানেই থামলেন না। বরং জানালেন, বাংলাদেশ সফর সেরে রাষ্ট্রপতি দেশে ফেরার পরেই তাঁর কাছে যান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। প্রণববাবুকে সে দিন মনমোহন বলেন, আমার বিশ্বাস ছিল, আপনার বাংলাদেশ সফর সফল হবে। আশা করি মরিশাস সফরও সফল হবে। আমি চাই, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নয়াদিল্লির দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নিবিড় করতে আপনি আরও বিদেশ সফর করুন। তা ছাড়া ৯ বছরের ইউপিএ শাসনে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি আপনি যে ভাবে দেখেছেন, আর কারও সেই অভিজ্ঞতা নেই। রাষ্ট্রপতির সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রণববাবুর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর ও তার পর এই মরিশাস সফরের নেপথ্যেও রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর তৎপরতা। না হলে রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব নেওয়ার পর তড়িঘড়ি বিদেশ সফর শুরু করার বিশেষ আগ্রহ প্রণববাবুর ছিল না।
কিন্তু মনমোহনের সচিবালয়ের কর্তাদের বক্তব্য, ঠিক যে ভাবে দুই চিনা রাষ্ট্রনায়ক হু জিনতাও এবং ওয়েন জিয়াবাও যৌথ ভাবে আন্তর্জাতিক কূটনীতি সামলাচ্ছেন, তেমন মেকানিজম সহজে গড়ে ফেলতে পারেন মনমোহন-প্রণব। সাউথ ব্লকের কূটনীতিকদের মতে, সে দিক থেকে ভারতে শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম রাখার স্বার্থে রাষ্ট্রপতির বাংলাদেশ সফরের যেমন গুরুত্ব ছিল, তেমনই দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রশ্নে মরিশাস সফর তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে। কেন না ভারতে সিংহভাগ বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগই আসে মরিশাস মারফৎ (মরিশাস রুট)। দেশকে মন্দার গ্রাস থেকে বের করতে সেই বিনিয়োগের পরিমাণ আরও বাড়ানোই এখন লক্ষ্য মনমোহনের।
কূটনৈতিক সূত্রে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির এই সফরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যেমন উঠে আসবে কর ফাঁকি রোধে দু’দেশের বোঝাপড়ার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার প্রসঙ্গ, তেমনই প্রণববাবুর উপস্থিতিতে দু’দেশের মধ্যে সই হতে পারে তিনটি চুক্তি (রাষ্ট্রপতি নিজে কোনও চুক্তি সই করেন না।) তা ছাড়া ভারত মহাসাগরে মরিশাসের ভূ-কৌশলগত অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। মরিশাস-সহ গোটা আফ্রিকায় বেজিং যখন প্রভাব আরও বাড়াতে সক্রিয়, তখন নয়াদিল্লির সঙ্গে সেখানকার বাণিজ্য সম্পর্কের শিকড় আরও গভীরে পৌঁছে দেওয়া নিয়েও কথা হবে। চলতি সফরে মরিশাসের রাষ্ট্রপতি রাজকেশ্বর পুর্যাগ ও প্রধানমন্ত্রী নবীন চন্দ্র রামগুলামের সঙ্গে আলাদা ভাবে বৈঠক করবেন প্রণববাবু।
মরিশাস সফরের পর দেশে ফিরে কিছু দিনের মধ্যে শ্রীলঙ্কা সফরেও যাবেন প্রণববাবু। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলোচনাও হয়েছে। প্রভাকরণ-পুত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যখন গোটা দক্ষিণ ভারত উত্তাল, তখন আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা এবং ঘরোয়া রাজনীতির কারণেই রাষ্ট্রপতির সেই সফরের গুরুত্বও অনেক।
রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের ওই আমলাটি এ বার পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন, এর পরেও বলবেন মরিশাস সফর কেবলই আনুষ্ঠানিক? নাকি বলবেন, নয়াদিল্লির তরফে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা! |