দরপত্র নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ। আর তাতেই চার মাস ধরে আটকে রয়েছে রাজ্যের প্রায় এক কোটি কিশোর-কিশোরীকে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট ক্যাপসুল খাওয়ানোর কাজ।
ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ১০-১৯ বছরের মেয়েদের ৯৮% কম-বেশি রক্তাল্পতায় ভোগে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশের প্রবল রক্তাল্পতা রয়েছে। এদের অপুষ্টিও খুব বেশি। পরে সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় এই মেয়েদেরই মৃত্যুর হার সর্বাধিক। এদের সন্তানও বেশির ভাগ সময় জন্ম থেকেই অপুষ্টির শিকার হয়। রাজ্যে বয়ঃসন্ধির প্রায় ৪০% ছেলেও রক্তাল্পতায় ভুগছে। এই পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব স্কুলে-স্কুলে আয়রন-ফলিক অ্যাসিড ক্যাপসুল দেওয়ার কাজ শুরু করা দরকার ছিল বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
কেন্দ্রীয় সরকারের উইফস (উইকলি আয়রন অ্যান্ড অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট) প্রকল্পের আওতায় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের সপ্তাহে একটি করে আয়রন ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা। প্রকল্পটি ২০১২ সালের নভেম্বরেই চালু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তা হলে এই দেরির কারণ কী? দরপত্র ডাকায় কোনও ত্রুটি হলেও তা কেন জরুরি ভিত্তিতে মিটিয়ে নেওয়া হচ্ছে না? স্বাস্থ্য-কর্তারা জানাচ্ছেন, সমস্যা এতই জট পাকিয়েছে যে সহজে খোলার নয়। |
তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, “ছেলেমেয়েদের শরীরে আয়রনের ঘাটতি ও রক্তাল্পতার চেয়েও বিভিন্ন ওষুধ সংস্থার স্বার্থের লড়াই প্রধান হয়ে উঠছে।” স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, ‘হেলথ সার্ভিস কর্পোরেশন’-এর উপর বছরে প্রায় ৪৮ কোটি ক্যাপসুল কেনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রক্রিয়া শুরু হতেই গোলমাল সামনে আসে।
কী ধরনের গোলমাল? হেলথ সার্ভিস কর্পোরেশন সূত্রে খবর, প্রথম বার ক্যাপসুলের জন্য দরপত্র ডাকা হয় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে। তাতে কোনও সংস্থা সাড়া দেয়নি। দ্বিতীয় বার দরপত্রের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় নভেম্বরে। দরপত্র খোলা হয় ডিসেম্বরে। যে সংস্থাটি নির্বাচিত হয়, তারা ক্যাপসুল প্রতি দাম দিয়েছিল ৪৮ পয়সা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সংস্থা ক্যাপসুল প্রতি দাম দিয়েছিল ৯১ পয়সা। দরপত্র হাতছাড়া হওয়ায় ওই দ্বিতীয় সংস্থাটি ‘হেলথ সার্ভিস কর্পোরেশন’-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর দেবব্রত পালের কাছে অনিয়মের অভিযোগ তোলে। প্রথম সংস্থাটির তৈরি ক্যাপসুলের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। প্রথম সংস্থাটি আবার দ্বিতীয় সংস্থার লাইসেন্সের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে বলে অভিযোগ।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এর পরই দেবব্রতবাবু দরপত্র কমিটির সদস্যদের কারণ দর্শানোর চিঠি দেন। তাতেই হেলথ সার্ভিস কর্পোরেশনের অন্দরে ক্ষোভ দেখা দেয়। একাধিক কর্তা ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গোলমালে হেলথ কর্পোরেশনের কাজ প্রায় লাটে উঠেছে বলে অভিযোগ। থমকে রয়েছে আয়রন ক্যাপসুল দেওয়ার কার্যক্রমও। দেবব্রতবাবু অবশ্য বলেছেন, “এই বিষয়ে বাইরের কাউকে আমি একটি শব্দও বলব না। তদন্ত কমিটি যা করার করবে।”
পরিস্থিতির গুরুত্ব আন্দাজ করে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি তৈরি করে বিষয়টির তদন্ত শুরু করেছে স্বাস্থ্য দফতর। সুশান্তবাবুর কথায়, “সব সময় যে সংস্থা সবচেয়ে কম দাম দেবে, তাকেই বরাত দেওয়া হবে, এমন না-ও হতে পারে। দামের সঙ্গে গুণমান, সংস্থার পরিচিতি এই রকম অনেক কিছুই বিচার্য।” তিনি আরও বলেন, “তদন্ত শেষ না হলে ক্যাপসুল কেনা যাবে না। তাতে ওষুধ দিতে দেরি হবে। কিছু করার নেই।” ওষুধ দিতে দেরি প্রসঙ্গে রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দফতরের সচিব অর্ণব রায় বলেন, “দেরি হচ্ছে দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর আমাদের স্পষ্ট করে কারণ কিছু জানাচ্ছে না।”
স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের আফশোস, কয়েক বছর আগে মেয়েদের রক্তাল্পতা দূর করতে কেন্দ্রের একটি ‘স্কুলভিত্তিক রক্তাল্পতা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প’ চালু হয়। সেই প্রকল্পও ঠিক ভাবে রূপায়িত হয়নি। তখন অভিযোগ ছিল, বিভিন্ন জায়গায় ট্যাবলেট খেয়ে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এত দিনে বড় আকারে বিকল্প প্রকল্প নেওয়া হল। কিন্তু তার ভাগ্যও ঝুলে রইল। |