বিল্টুর ছোটমামার মাথায় কিছু একটা চাপলেই হয়েছে, সেটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দেবে। বছর পাঁচেক আগে, হঠাত্ ছোটমামা উঠেপড়ে লাগল, ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণ করবে। বিল্টু তখন বেশ ছোট, কিন্তু তার মনে আছে সব। বাড়ির সকলকে ভূত দেখিয়ে ছাড়বে ছোটমামা। তো, তার জন্য কী ছোটাছুটি, বইপত্র কেনা! তার পর প্রেতবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। প্ল্যানচেট করার জন্য বন্ধুবান্ধব জোগাড় করে ফেলল। বাড়ির লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল একদম। বিল্টুর মা বলল, ‘হ্যাঁ রে দেবু, তুই পিয়োর সায়েন্সের ছেলে হয়ে ভূত বিশ্বাস করিস!’ কিন্তু কে কার কথা শোনে। বেশ কিছু দিন চলল এ রকম। তার পর রণে ভঙ্গ দিল সে। বাড়ির লোককে ভূত দেখানো আর হল না।
ছোটমামা একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের সায়েন্সের টিচার। বছরে অঢেল ছুটি। আর তাই হাতে সময়ও অনেক। ভূতের বোঝা ঘাড় থেকে নামার পর কিছু দিন যেতে না যেতেই ছোটমামা তার নতুন প্রোগ্রাম ঠিক করে ফেলল। এ বার সে প্রমাণ করে ছাড়বে, পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহেও বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, আর তারা মাঝে মাঝেই ডিশের মতো আকৃতির মহাকাশযানে চেপে আমাদের পৃথিবীতে এসে ঘুরে যায়। ডিশের আকৃতি, তাই বলা হয় ফ্লাইং সসার। আবার ইউফো-ও বলা হয়, মানে, আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট।
প্রথমেই বেশ বড়সড় একটা দূরবিন কিনে ফেলল ছোটমামা। আর সন্ধের পর ছাদে উঠে সেই দূরবিন আকাশের দিকে তাক করে বসে থাকত প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত। প্রচুর বিদেশি বই কিনল। তাতে সব কত রকম ছবি। ভিনগ্রহের যান আর প্রাণীদের ফটো তুলে রেখেছে অনেকে। ‘আমাদের সৌরজগতের কোনও গ্রহে প্রাণ নেই,’ বিল্টুকে বুঝিয়েছিল ছোটমামা, ‘কয়েক আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ থেকে প্রাণীরা আসে আমাদের পৃথিবীতে।’
‘আলোকবর্ষ কাকে বলে?’ বিল্টু জিজ্ঞেস করেছিল ছোটমামাকে।
‘আলোর গতিবেগ জানিস তো?’ ছোটমামার প্রশ্ন।
‘সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল,’ উত্তরটা যেন একেবারে ঠোঁটের গোড়ায় ছিল বিল্টুর।
‘এই এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিবেগে আলো এক বছরে যতটা যায় তাকেই বলে আলোকবর্ষ।’
‘সে তো বিশাল দূরত্ব।’
‘হ্যাঁ, আর এ রকম দু’তিন আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ থেকে আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি বুদ্ধিমান প্রাণীরা ফ্লাইং সসারে চেপে মাঝে মাঝে ঘুরে যায় পৃথিবীতে। অনেকেই দেখেছে এদের। তবু বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই মানতে চান না এ সব। বলেন সব গাঁজাখুরি। কিন্তু এত লোক দেখেছে, সব মিথ্যে! দেখবি, আমি এ বার হাতেনাতে প্রমাণ করে ছাড়ব যে, ভিনগ্রহীরা সত্যিই আসে এখানে।’
তবে সব চেষ্টাই বিফলে গিয়েছিল। ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের টিকিটিও খুঁজে পায়নি ছোটমামা। |
অনেক দিন হয়ে গেল ছোটমামা বিল্টুদের বাড়ি আসে না। ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়। সে দিন বিল্টুর মামি আর মামাতো ভাই পলাশ এসেছিল বিল্টুদের বাড়ি। ওদের কাছ থেকে জানা গেল, ছোটমামা সম্ভবত আবার কোনও একটা উদ্ভট ব্যাপার নিয়ে মেতে উঠতে চলেছে। কিন্তু যেহেতু প্রতিবারই তার সব চেষ্টা ভেস্তে যায়, তাই এ বার কাউকে কিছু জানাচ্ছে না। তবে ভেতরে ভেতরে যে কিছু একটা করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখন গরমের ছুটি। স্কুল বন্ধ।
কয়েক দিন হল, ছোটমামা বেশির ভাগ সময়েই ঘরের দরজা বন্ধ করে ভেতরে থাকে। ঘরে আর কাউকে ঢুকতেও দেয় না। আর ঘর থেকে বেরলে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেয়।
কী করছে ছোটমামা? বিল্টু ঠিক করল মামাবাড়ি যাবে ছোটমামিদের সঙ্গে। গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধ এখন।
মামাবাড়ি পৌঁছে বিল্টু দেখল ছোটমামা বাগানে পায়চারি করছে। একটু পরে ছোটমামা ঘরে ঢুকতেই বিল্টু ছুটে গেল সেখানে। ছোটমামা বলল, ‘আমার ঘরে আয়, তোকে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখাব।’
ছোটমামার ঘরটা তালাবন্ধ ছিল। তালা খুলে বিল্টুকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল ছোটমামা। ঘরটা বিশাল, একটা হলঘর বলা চলে। ঘরটার মাঝামাঝি প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা হয়েছে। সেখানে একটা দরজাও রয়েছে। ঘরটা তো আগে এ রকম ছিল না! একটু অবাক হল বিল্টু। ছোটমামা হঠাত্ কার উদ্দেশে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘এ দিকে এক বার এসো তো তোমরা।’
মুহূর্তের মধ্যে প্লাইউডের দরজা খুলে গেল, আর বিল্টুকে স্তম্ভিত করে দিয়ে দু’জন মানুষ এসে দাঁড়াল। দেখে বিল্টুর তো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এক জনকে ঠিক তার মতো দেখতে, আর এক জন অবিকল তার ছোটমামা। যেন জেরক্স কপি। দু’জনেই বিল্টুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘হ্যালো।’
বিল্টুর মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরলো না। ওর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ছোটমামা বলল, ‘এরা দু’জন এই পৃথিবীর কেউ নয়। পৃথিবী কেন, এই ব্রহ্মাণ্ডেরই কেউ নয়। এদের বসবাস অন্য এক ব্রহ্মাণ্ডে। যাকে বলে সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ড বা প্যারালাল ইউনিভার্স। আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের পাশাপাশিই রয়েছে এই সমান্তরাল ব্রহ্মাণ্ড। বিজ্ঞানীরা এই ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। এই সমান্তরাল মহাবিশ্বে যারা থাকে, তারা ঠিক আমাদের মতোই দেখতে। হুবহু আমাদের মতো,’ একটানা বলে থামল ছোটমামা।
জেরক্স কপি দু’জন বিল্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছিল মিটিমিটি। এক জন বলল, ‘আমরা কালই ফিরে যাব, তবে তোমার মামাকে আমরা নিয়ে যাব আমাদের ব্রহ্মাণ্ডে। সেখানে যাওয়ার জন্য কোনও যানের দরকার হয় না। ডাইমেনশন বা মাত্রা পরিবর্তন করেই যাওয়া যায় সেখানে।’
বিল্টু কোনও উত্তর দিতে পারল না। সে শুধু এক বার তাকাল তার ছোটমামার দিকে। ছোটমামা বলল, ‘কোনও জিনিসের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং বেধ হল সেই জিনিসটার ডাইমেনশন বা মাত্রা। এ ছাড়া সময় বা কাল একটা মাত্রা, এগুলো ছাড়া আরও অনেক মাত্রা আছে। সে সব জটিল বিষয় তুই বুঝবি না। এই মাত্রা পরিবর্তনের সময় একটা গোলমাল হয়ে যাওয়ার ফলে ওরা চলে এসেছে এখানে।’ ‘আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের সঙ্গে?’ বিল্টু জিজ্ঞেস করল। ‘যেতে পারি, কিন্তু এই সব ব্যাপার কাউকে বলবি না তো?’ ছোটমামা গম্ভীর হয়ে বলল। ‘না, না,’ জোরে জোরে মাথা নাড়ল বিল্টু।
অন্য ব্রহ্মাণ্ডের এই মানুষ দু’জন পর দিনই উধাও হয়ে গিয়েছিল। বিল্টুকে তো দূরের কথা, ছোটমামাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি। ছোটমামা বলেছিল যে, ওরা নাকি আবার ফিরে আসবে। তখন নিয়ে যাবে ওদের, তবে বিল্টু যেন মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। বিল্টু অবশ্য বলেনি কাউকে। তবে কত দিন চেপে থাকতে পারবে কে জানে! |