অসাড়তা কাটিয়ে স্কুলে ফেরার স্বপ্ন অনন্যার
শীর্ণ চেহারার মধ্যে চোখ দু’টোই বড় উজ্জ্বল। শরীরে দীর্ঘ লড়াইয়ের ছাপ স্পষ্ট। এখনও ক্যাথিটার খোলা হয়নি। তাতে কী, জিন্স-টপে দিব্য লাগছিল ছোট মেয়েটিকে। ডাক্তারদের হাত ধরে সামনে হেঁটে এল বছর বারোর ‘বিস্ময় বালিকা’ অনন্যা। বিস্ময়ই বটে! পক্ষাঘাতে অসাড় হয়ে যাওয়া গোটা শরীরটাকে নতুন করে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছে সে। ওষুধ এবং ‘রিহ্যাবিলিটেশন’-এর জোরে।
জয়ের এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে চিকিৎসকরা বেছে নিয়েছিলেন অনন্যার জন্মদিনকে। সব আয়োজন করেছিলেন তাঁরাই। নিজেদের হাতে সাজিয়েছেন হাসপাতালের ঘর, কেক এনেছেন। অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত ছিলেন শহরের বহু ডাক্তার। আর সব কিছুর পিছনে বার্তা ছিল একটাই আংশিক বা পুরোপুরি পক্ষাঘাত মানেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়, বরং সেখান থেকেও ফেরা যেতে পারে স্বাভাবিক জীবনে। রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে সেটা সম্ভব। কিন্তু এই সহজ সত্যিটা অনেকেই জানেন না।
গত বছরের মে মাস। পেটে ব্যথা নিয়ে স্কুল থেকে ফিরেছিল ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী অনন্যা। অবস্থা ক্রমেই খারাপ হল। শুরু হল মাথার যন্ত্রণাও। বেশ কিছু দিন পরে ধরা পড়ল, তার মাথায় যক্ষ্মা হয়েছে। মানুষের মাথাই গোটা শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সেখানেই এমন একটা সংক্রমণ! মস্তিষ্কের বাঁ দিকের স্নায়ুকোষগুলি শরীরের ডান দিকের চালচলন নিয়ন্ত্রণ করে। আর মগজের ডান দিক চালায় দেহের বাঁ দিককে। তাই মগজের বাঁ দিকটা যদি অকেজো হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গেই অসাড় হয়ে যায় শরীরের ডান দিক। মস্তিষ্কের ডান দিক অকেজো হলে পরিণতি ঠিক উল্টো। অনন্যার ক্ষেত্রে বিষয়টা সব চেয়ে ভয়াবহ। টিবি সংক্রমণ ওর গোটা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যায়। ফলে শরীরের দু’পাশই অসাড় হয়ে যায়। কথার শব্দজাল তৈরি হয় মাথাতেই। ফলে হাত-পা অসাড় হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে গিয়েছিল মুখের ভাষাও।

জন্মদিনে মায়ের সঙ্গে। ছবি: সুদীপ আচার্য
অসাড়ত্ব থেকে ক্রমশ শরীর জুড়ে ঘা হতে লাগল। পেশী শক্ত হতে হতে বেঁকে যেতে লাগল হাত-পায়ের সংযোগস্থল। চেহারা হল কঙ্কালসার। খাওয়ানোর জন্য মুখে ঢোকাতে হল রাইল’স টিউব। সেই সঙ্গে ক্যাথিটার ও ট্রাকিওস্টোমি টিউবও লাগাতে হল। অনন্যার মা শোভা সামন্ত জানালেন, এ ভাবে লাখ দশেক টাকা খরচের পর ডাক্তাররা এক দিন জানিয়েছিলেন, টিবি-র চিকিৎসা হয়ে গিয়েছে। আর তাঁদের কিছু করার নেই।
অজ্ঞতাটা ঠিক এইখানেই জানাচ্ছেন রিহ্যাবিলিটেশন দলের প্রধান, জেনারেল ফিজিশিয়ান এবং রিহ্যাবিলিটেশনিস্ট মৌলিমাধব ঘটক। তাঁর কথায়, বেশির ভাগ লোকই জানেন না, এ ধরনের রোগের পর কাউকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে রিহ্যাবিলিটেশন প্রয়োজন। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত রোগীকে এ ভাবে বাড়িতে রেখে দিলে, তাঁকে এক রকম মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। বাঁচাতে পারে শুধু রিহ্যাবিলিটেশন।
মৌলিমাধববাবুর খোঁজ পেয়ে অনন্যার পরিবার যখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখন সে পুরোপুরি শয্যাশায়ী। শরীরে তিন-তিনটে নল লাগানো। চারটে হাত পা-ই বেঁকে গিয়েছে। মুখ সব সময়ই হাঁ হয়ে থাকে। “মাঝেমধ্যেই খুব কাঁদত ও। কান্নার কোনও আওয়াজ ছিল না। শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ত। বুঝতাম ও কাঁদছে, অনেক কিছু বলতে চাইছে”, বললেন মৌলিমাধববাবু।
মৌলিমাধববাবুদের হাসপাতালে দু’মাস রিহ্যাবে থেকে চিকিৎসা করানোর পর এখন একটু একটু করে হাঁটতে শুরু করেছে অনন্যা। বসতে পারছে, গলায় একটু আধটু স্বর এসেছে, প্রায় এক বছর বাদে নতুন করে পেন ধরতে শুরু করেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও সুস্থ হয়ে উঠবে ও। গত সপ্তাহে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মাকে নিজে হাতে কেক খাওয়াল অনন্যা। চকোলেট হাতে দিতে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিল জনৈক শুভানুধ্যায়ীর দিকে। আস্তে করে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’।
গত দু’মাস ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদলের কড়া পাহারায় ছিল সে। আর তার সঙ্গে চলেছে ছ’টা থেরাপি ফিজিওথেরাপি, বিদ্যুৎ তরঙ্গের সাহায্যে ইলেকট্রোথেরাপি, মনের জোর বাড়াতে সাইকোথেরাপি, মুখে কথা আনতে স্পিচ থেরাপি, দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে অকুপেশনাল থেরাপি এবং কোনও জিনিস ছুঁয়ে তার আকার-আকৃতির ধারণা পেতে কগনিটিভ থেরাপি। আসলে তার মস্তিষ্কে বিভিন্ন কাজের জন্য ভারপ্রাপ্ত কোষগুলো টিবি-র সংক্রমণে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ওই কোষগুলোর নীচে বেশ কিছু কোষস্তর এত দিন ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। সেই কোষগুলোকে নতুন করে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেয় এই ছয় থেরাপি।
পশ্চিম মেদিনীপুরের জোধঘনশ্যামপুরে বাড়ি অনন্যাদের। চিকিৎসার এত জটিল তত্ত্ব হয়তো বোঝেন না গ্রামের আটপৌরে মহিলা শোভাদেবী। তিনি দেখছিলেন, জন্মদিনে মেয়েকে ঘিরে ডাক্তারবাবুদের উচ্ছ্বাস। একটু সুস্থ হওয়ার পর যাঁদের অনন্যা বলেছিল, তাঁদের হাত থেকে সে কেক খেতে চায়। জন্মদিন পালনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল তখনই। সেই জন্মদিনের আসরে আপ্লুত মা বললেন, “আগের হাসপাতালে বলেছিল, ও কোনও দিন হাঁটতে-চলতে পারবে না। ও পেরেছে। আমি তাতেই খুব খুশি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.